৩ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৫

খানাখন্দে বেহাল সড়ক, দুই বছরেও দুর্ভোগ শেষ হয়নি

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় হানিফ ফ্লাইওভারের (উড়াল সেতু) নিচে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উভয় পাশের প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে যানজট লেগেই আছে। খানখন্দে ভরা এই বেহাল সড়কে যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি চলছে গত দুই বছর ধরে। সড়কে পানি ভরা বিপজ্জনক গর্তগুলো গাড়ি চালকদের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, কমিয়ে দিচ্ছে গাড়ির গতি। চালকদের অভিযোগ, এই সড়কে যেসব গাড়ি চলাচল করে সেসব গাড়ির আয়ু কমছে।

এ অবস্থার কারণে ফ্লাইওভারে চাপ বাড়ছে। নিচের সড়ক এড়িয়ে চলছে অনেকেই। ফ্লাইওভারের ওপর দুর্ঘটনাও বাড়ছে।

গতকাল বুধবার বিকেলে এই সড়কে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী থানার সামনে থেকে ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা পর্যন্ত সড়কের অনেক অংশই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

ব্যস্ত এ সড়কে পিচ-খোয়া উঠে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় অনেক খানাখন্দ। এসব খানাখন্দে সামান্য বৃষ্টিতে পানি জমে যায়। এ পরিস্থিতি এলাকাবাসীর দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক রিকশাচালক ‘আর যাওয়া সম্ভব না’ বলে বাধ্য হয়ে যাত্রীদের মাঝপথে নামিয়ে দিচ্ছেন।
দুর্ঘটনা এড়াতে মূল সড়ক ছেড়ে কিছু যানবাহন ফুটপাতে উঠে যাচ্ছে।

এই সড়ক দিয়ে নিয়মিত চলাচল করা যানবাহনের চালক ও স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় দুই বছর ধরে বহাল এই দুরবস্থা। মাস তিনেক আগে সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হলেও সেই কাজে তেমন গতি নেই। কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারিরও অভাব রয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়ক পানি ও কাদায় একাকার।

আর রোদের সময় ধুলাবালিতে ভরা।
রয়েল পরিবহনের বাসচালক জাবেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই রাস্তায় খুবই ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। এত বেশি ঝাঁকুনি লাগে, যাত্রীরা গালাগাল করে। এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এই যে বড় বড় গর্ত দেখছেন, প্রায় গাড়ি আটকা পড়ছে এবং গাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

এলাকার রিকশাচালক মতি মিয়া বলেন, কাজ শুরু করেছে অনেক দিন। মাত্র কিছু জায়গা শেষ করেছে। এভাবে কাজ করলে তো কয়েক বছর লাইগা যাইবো। এহানে সবচেয়ে বেশি কষ্ট রিকশা ও ভ্যানওয়ালাগো।

কাজ শেষ করতে কত দিন লাগবে—এ প্রশ্নে স্থানীয় ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাসুম মোল্লা বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গত রমজান মাসে কাজ শুরু করেছে। আশা করি মাস দুয়েকের মধ্যে টোল প্লাজা পর্যন্ত কাজ শেষ হবে।

কাজের ধীরগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ব্যস্ত সড়ক। এক পাশ বন্ধ করে অন্য পাশে কাজ করতে হয়। আবার পাশেই মাছের বাজার। এসব কারণে কাজ শেষ করতে সময় নিচ্ছে। তবে কিভাবে দ্রুত কাজ শেষ করে মানুষের দুর্ভোগ কমানো যায় আমাদের পক্ষ থেকে সে চেষ্টা করছি।’

এর আগে শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে নিমতলী পর্যন্ত ফ্লাইওভারটির মূল অংশের নিচের শোচনীয় অবস্থা চোখে পড়ে। এই অংশে স্থায়ী হতে চলেছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাস-ট্রাকের পার্কিং, বিভিন্ন ধরনের দোকান, রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ, ঘোড়ার আস্তাবল। কেউ কেউ আবার খুপড়ি ঘর বানিয়ে বহাল তবিয়তে বসবাসও করছেন। কর্তৃপক্ষের নজরদারিও নেই।
অভিযোগ রয়েছে, যারা এগুলো দখল করে রেখেছে তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মচারী ও পুলিশের অসাধু অংশের প্রশ্রয়ে তারা বেপরোয়া।

ভুক্তভোগীরা জানান, রাজধানীর সায়েদাবাদ, গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ী সড়কের যানজট কমাতে হানিফ ফ্লাইওভার স্থাপন করা হয়। কিন্তু ওপরে যানবাহনের গতি বাড়লেও নিচের সড়কের চিত্র পাল্টায়নি। বরং দখল, দূষণ ও সংস্কারের অভাবে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। ফ্লাইওভারের নিচে গাছ লাগানোসহ দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ তৈরি করার কথা থাকলেও তা হয়নি।

ফ্লাইওভারের দুই পাশের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, রাতের বেলায় নিচের অংশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অনেক গণপরিবহনের রাতের ঠিকানা এখানে।

যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ফ্লাইওভারের নিচের অংশে দেখা যায়, ময়লার ভাগাড়, মল-মূত্রের দুর্গন্ধ এড়াতে কয়েকজন নাকে হাত চেপে হাঁটছেন। যাত্রাবাড়ী মাছ বাজারের সামনে ফ্লাইওভারের নিচের অংশে রাখা হয়েছে সারি সারি মাছ রাখার বাক্স। যাত্রাবাড়ী অংশের শুরুর নিচের অংশে বসেছে সবজির বাজার এবং এক পাশে রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ।

দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার গোলচত্বরের প্রায় ৩০ শতাংশজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে ব্যক্তিগত নার্সারি। পাশেই রয়েছে পুলিশের একটি ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম। কিন্তু সেখানে কোনো পুলিশ সদস্য নেই। রুমের ভেতর ময়লা-আবর্জনা। রয়েছে একাধিক দোকানপাট। এখানে দোকান করার অনুমতি কিভাবে পেলেন—এই প্রশ্নে বেশির ভাগ দোকানি নিরুত্তর থাকেন।

কাপ্তান বাজার এলাকার বাসিন্দা আজহার উদ্দিনের দাবি, ‘নানা রকমের দুর্গন্ধের কারণে ওই এলাকায় সব সময় নাক-মুখ ঢেকে চলাচল করতে হয়। সেখানে ফ্লাইওভারের নিচের অংশে দেয়াল তুলে মুরগির দোকান ও খাবারের হোটেল বসানো হয়েছে।

ফ্লাইওভারের নিচে গুলিস্তান এলাকায় দেখা যায় জুতার গোডাউন স্থাপন করা হয়েছে। চানখাঁরপুল এলাকায় ঘোড়ার আস্তাবল ও অস্থায়ী দোকানে সড়কের অনেকটাই বেদখল হয়ে গেছে। বঙ্গবাজার থেকে নিমতলী গেট পর্যন্ত ঘোড়ার বিষ্ঠার দুর্গন্ধে টেকা দায়। যাত্রাবাড়ী-নিমতলী অংশে ফ্লাইওভারের নিচে অনেক স্থানে প্রস্রাবের দুর্গন্ধে পথচারীদের চলাচল করতে হয় নাকে হাত চেপে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, এই ফ্লাইওভারের নিচের অংশ অবৈধ দখলমুক্ত করে সরকার যদি যথাযথ ব্যবহারের উদ্যোগ নেয় তাহলে তা নাগরিক ভোগান্তি কমাবে। যানজটমুক্ত অবস্থায় নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত হবে। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয় জরুরি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। শিগগিরই আবার অভিযান চালানো হবে। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের নিচের অংশে নান্দনিক স্থাপনা করার লক্ষ্যে টেন্ডার হয়েছে। পর্যায়ক্রমে কাজ শুরু হবে।


https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/08/03/1304770