৩ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:১৬

প্রতারণার ফাঁদে শিক্ষকরা!

-মৌখিক আশ্বাসেই আন্দোলন স্থগিত

দীর্ঘ ২১ দিন রাজপথে অবস্থান করে শুধু দাবি পূরণের মৌখিক আশ্বাসেই ক্লাসে ফিরেছেন শিক্ষকরা। যদিও শিক্ষক নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই দাবি আদায়ে তাদের অনড় মনোভাবের কথা বলে সাধারণ শিক্ষকদের নিয়ে মাঠ গরম করার মতো বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু অবশেষে আন্দোলনের ফলাফলে অশ্বডিম্ব নিয়েই রাজপথ ছাড়তে হয়েছে তাদের। আন্দোলনে অংশ নেয়া অনেক শিক্ষকই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানিয়েছেন আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে আমাদের রাজপথে নামানো হলেও এখন দাবি পূরণ না করেই ক্লাসে ফিরতে হচ্ছে আমাদের।

আন্দোলনে অংশ নেয়া অনেক শিক্ষক নয়া দিগন্তকে জানান, দাবি আদায় না করেই রাজপথ থেকে সরে আসায় আমরা এখন সহকর্মী কিংবা পরিবারের কাছেও ছোট হয়েছি। মিথ্যাবাদী ধোঁকাবাজ হিসেবে আমাদের নেতৃবৃন্দকে অন্যরা ট্রিট করছে। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দাবি আদায়ের জন্য কমিটি গঠনের আশ্বাস দেয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো ডেটলাইন আসেনি। এছাড়া চলতি বছরের মধ্যে জাতীয়করণের অন্যান্য প্রক্রিয়া শুরু করা নিয়েও শিক্ষকদের মধ্যেই যথেষ্ট সন্দেহ বা সংশয়ও রয়েছে।

এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা কবির বিন আনোয়ারের আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে যান শিক্ষক নেতারা। রাত ৮টার দিকে সভায় বসেন শিক্ষক নেতারা। সভায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক উপকমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মৌখিক আশ্বাসেই মূলত আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। যদিও শিক্ষকদের এই আন্দোলন স্থগিত করাকে শিক্ষকদের সাথে একটি প্রতারণা আর প্রহসনের সাথে তুলনা করেছেন শিক্ষকদের অপর একটি সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বাশিস) সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি। তার মতে দাবি আদায়ের আগে এভাবে মাঠ থেকে সরে আসার মানেই হচ্ছে সমগ্র শিক্ষকশ্রেণীর সাথে তামাশার শামিল। গত ২১ দিনে শিক্ষার্থীরাও অনেকে তাদের পাঠ বা অধ্যয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা লাখ লাখ শিক্ষকের আবেগ অনুভূতি আর দুর্বলতাকে পুঁজি করে নিজেরাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। শিক্ষকদের দাবি যেখানে গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল সেখান থেকে সরে আসার অর্থই হলো তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধা বা স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন।

সূত্র মতে, গত ১১ জুলাই থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি নিয়ে মাঠে নামেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতিরি (বিটিএ) নেতৃবৃন্দ। একই দাবিতে এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আরো প্রায় ৯টি শিক্ষক সংগঠন। এর মধ্যে বিটিএ, বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম, শিক্ষক কর্মচারী ইউনিয়ন, শিক্ষক কর্মচারী মহাজোট, আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন, আদর্শ শিক্ষক পরিষদও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এর বাইরেও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বাশিস) ও অন্যান্য আরো কয়েকটি শিক্ষক সংগঠনও শিক্ষকদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। বেতন বৈষম্য, উৎসবভাতা ও চিকিৎসাভাতা নিয়েও অসন্তোষ থাকায় তারা তা দূর করতে ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক অধিকার আদায়ে সরকারের কাছে দাবি জানায়। পরে তারা রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।

অবস্থান কর্মসূচির এক পর্যায়ে গত ১৬ জুলাই বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক পুলিশের লাঠিচার্জে আহতও হন। পুলিশের হাতে আহত হয়ে নোয়াখালীর একজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে তিন দিন পর মারা যান। এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির সাথে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক হলেও সেখানে কোনো সুরাহা না হওয়ায় রাজপথকেই দাবি আদায়ের একমাত্র অবলম্বন বলে মনে করেন সাধারণ শিক্ষকরা। তারা ক্লাসরুমে তালা ঝুলিয়ে স্কুল ত্যাগ করে ঢাকায় এসে আন্দোলনে শরিক হন। কিন্তু এরপরও শিক্ষামন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যেতে আহবান জানান।

শিক্ষকরা এক দফার আন্দোলনে ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করা ছাড়া ঘরে ফিরে যাবো না। প্রয়োজনে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও শিক্ষক নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চান এবং তার মুখ থেকেই দাবি আদায়ের পথ কী বা উপায় কী হবে তা জানতে চান। কিন্তু এরপরও কোনোরূপ সাড়া পাননি শিক্ষকরা। পরে গত ২৭ জুলাই রাজধানীতে বিরোধী দলের সমাবেশ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকারের চাপে (যদিও বলা হয়েছে নিরাপত্তার জন্য) সাময়িক সময়ের জন্য রাজপথে থেকে সরে যান শিক্ষকরা। পরে আবারো গত ২৯ জুলাই থেকে মাথায় কাফনের কাপড় পরে রাজপথে অবস্থান নেন তারা। কিন্তু গত বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং শিক্ষা উপমন্ত্রীর সাথে বিটিএ নেতৃবৃন্দের বৈঠকে দাবি আদায়ে কমিটি গঠনের মৌখিক আশ্বাসে রাজপথ ছেড়ে ক্লাসে ফিরেছেন শিক্ষকরা।

অবশ্য এর আগেও সরকারের নানামুখী চাপেই আন্দোলন থেকে সরে গিয়েছিলেন শিক্ষকরা। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে গত ১১ জুলাই থেকে অব্যাহত কর্মসূচিতে হঠাৎ করেই গত ২৬ জুলাই বুধবার সন্ধ্যায় ছন্দপতন ঘটে। নিরাপত্তার স্বার্থে ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে পরবর্তী শুক্রবার বেলা ২টা পর্যন্ত রাজপথের আন্দোলনে ভাটা পড়ে শিক্ষকদের। তবে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রেস ক্লাবের সামনেই অবস্থান করার ঘোষণা দিলেও উল্লেখযোগ্য কোনো নেতৃবৃন্দ ওই দু’দিন রাজপথে সরব ছিলেন না।

অন্যদিকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে কিংবা কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে সরকারের পাতানো ফাঁদে শিক্ষকদের ফেলার জন্য শুরু থেকেই চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগে আন্দোলন চলাকালেও শিক্ষকদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম বানচাল করতে শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুদিনের কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। এই কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষকদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ কাউসার আহমেদ।

চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের আগেই আন্দোলন থেকে কেন সরে গেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল বুধবার বিকেলে বিটিএর সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাউসার আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের মূল দাবি ছিল চারটি। এর মধ্যে প্রধান দাবি ছিল জাতীয়করণের জন্য কমিটি গঠন করা এবং সেই কমিটিতে আমাদের শিক্ষক প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কমিটি গঠনের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। একই সাথে বাকি তিনটি দাবির মধ্যে শতভাগ উৎসবভাতা, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমাদের সবকটি বিষয়েই সমাধান করতে কমিটি গঠনের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। সেই আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই আমরা আন্দোলন স্থগিত করেছি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক এ বি এম ফজলুল করীম বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক-চতুর্থাংশ দায়িত্ব পালন করছে। অথচ তাদের এই অসামান্য অবদানের জন্য পদ বিন্যাসের মাধ্যমে সম্মান দেখানো হচ্ছে না, আর্থিক স্বীকৃতিটা যেন তাদের ওপর দয়া বা অনুগ্রহ মনে করা হচ্ছে। এমনকি এ বিষয়ে কথা বলারও সুযোগ দিচ্ছে না। সরকার যদি দেশের শিক্ষানীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে চায় তাহলে মাধ্যমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করতে হবে। আমরা আশা করি সরকার শিক্ষকদের এই দাবির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাবেন।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অনেক আগে থেকেই বলছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসবভাতা, এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসাভাতা পান। একই কারিকুলামে একই সিলেবাসে পাঠদান করিয়েও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধানদের থেকে এক ধাপ নিচে বেতন দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। তাছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নেয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করা হলেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট করতে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষক। তাই স্মার্ট শিক্ষক পেতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ মাধ্যমিক শিক্ষা সরকারীকরণের বিকল্প নেই।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/766939