৩ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:১৩

পৃষ্ঠপোষকতার অর্থনীতি নির্মাণের কৌশল

ড. মাহবুব উল্লাহ্

পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ড. আবু মাহমুদ পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল, ‘Political Economy of Patronages’. এ প্রবন্ধের মাধ্যমে ড. আবু মাহমুদ দেখিয়েছেন কীভাবে মুদ্রানীতি, করনীতি ও সাবসিডি ব্যবহার করে দেশে বৃহৎ বাইশ পরিবার সৃষ্টি করা হয়েছিল।

বৃহৎ বাইশ পরিবারগুলো যে পলিসির সুবাদে প্রচুর অর্থ লাভ করেছিল তার নাম ছিল ‘বোনাস ভাউচার স্কিম।’ এ স্কিমের মূল কথা ছিল, যদি কোনো রপ্তানিকারক ১০০ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করতে পারে, তাহলে তাকে ১০০ ডলারের দেশীয় রুপির বিনিময় হারের দেড়গুণ অর্থ দেওয়া হতো। অর্থাৎ ১০০ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে ১৫০ ডলারের সুবিধা পাওয়া যেত। রপ্তানিকারকরা এ অতিরিক্ত অর্থ নানা কাজে ব্যবহার করত। এ অর্থ দিয়ে বিদেশে ব্যবসায়িক যোগাযোগ কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা যেত। বোনাস ভাউচার স্কিমের আনুকূল্য ব্যবহার করা পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারকরা তাদের ব্যবসা রমরমা করতে পেরেছিল। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ তার এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, তৎকালীন পাকিস্তানের পাটশিল্প বস্তুত লাভজনক নয়।

বোনাস ভাউচারের সুবিধা ব্যবহার করে পাটশিল্পের মালিকরা ব্যাপক মুনাফা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ মুনাফা সত্যিকার অর্থে মুনাফা ছিল না। যে মুনাফা অর্জিত হয়েছিল তা ছিল কৃত্রিম মুনাফা। জনগণ থেকে আদায় করা ট্যাক্সের অর্থ ব্যবহার করা হতো বোনাস ভাউচার স্কিম চালু রাখতে। এভাবে পাটশিল্প টিকিয়ে রাখতে গিয়ে জনগণকে শোষণ করা হয়েছে।

তবে একথা স্বীকার করতে হবে, পাকিস্তানের পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা বিশ্ববাজারে ছিল এবং পাটশিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থানও হয়েছিল। কালেকটিভ বার্গেইনিংয়ের অধিকার থাকায় পাটশিল্পের শ্রমিকরা সময়ে সময়ে ধর্মঘট করে তাদের দাবি-দাওয়া আদায় করে নিত। কখনো কখনো এসব ধর্মঘট তিন-চার মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকত।

প্রথম আলো গত ১ আগস্ট সংখ্যায় প্রধান শিরোনাম করেছে, ‘‘খাতিরের’ প্রকল্প, ইচ্ছেমতো অনিয়ম’’। এ শিরোনামের সংবাদটি পড়ার পর আমার মনে উদয় হয়েছে ড. আবু মাহমুদের লেখা Poltical Economy of Patronages-এর শিক্ষা। পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের বর্তমান বয়স ৫৩ বছর চলছে। সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে যে মরণপণ সংগ্রাম হয়েছিল, আজ সেই লক্ষ্যকে ছুড়ে ফেলে পৃষ্ঠপোষকতার অর্থনীতির মাধ্যমে তাকে পদাঘাত করা হচ্ছে। ধনবৈষম্য অত্যন্ত উৎকটভাবে বাড়ছে। এর রাশ টেনে ধরার জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। বরং পৃষ্ঠপোষকতার নীতি অব্যাহত রেখে ধনীদের আরও ধনী করা হচ্ছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, দুস্থ ও পিছিয়ে পড়াদের প্রশিক্ষণে ব্যয় ৫০৩ কোটি টাকা।
নানাভাবে এসব প্রকল্প বাগিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ। বাস্তবায়নকারী এনজিও পর্ষদে রয়েছেন রাজনীতিক, সাবেক আমলা, চলচ্চিত্রের অভিনেতা। কথা ছিল ২১ দিনের প্রশিক্ষণ হবে। সে জায়গায় হয়েছে মাত্র ৭ দিনের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণার্থীদের নগদ টাকা পাওয়ার কথা, কিন্তু অনেকেই তা পাননি। বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীত নারীদের তালিকায় পুরুষরাও স্থান পেয়েছেন। তালিকায় থাকা অনেকে বলেছেন, তারা প্রশিক্ষণ পাননি।

এবার দেখা যাক কিছু কেইস স্টাডি। বাড়ির আঙিনায় ‘গ্রিন হাউজে’ কীভাবে সবজি চাষ করা যায়, এর প্রশিক্ষণ দিতে সরকারের কাছ থেকে ৪৯ কোটি টাকা নিয়েছিল প্রগতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। কথা ছিল বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীত নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারা পাবেন ৩০ হাজার টাকা দামের একটি করে গ্রিন হাউজ। তাতে সবজি চাষ করে নারীরা স্বাবলম্বী হবেন। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি ইউনিয়নের সালেহা বেগম ছিলেন এ প্রকল্পের সুফলভোগীর তালিকায়। গ্রিন হাউজে সবজি চাষ কেমন হচ্ছে, তা দেখতে গত ৩১ মে প্রথম আলোর প্রতিবেদক তার বাড়িতে যান। দেখা গেল বাড়ির আঙিনায় কোনো গ্রিন হাউজ নেই। সালেহা বেগম বিধবা বা স্বামী-নিগৃহীত নন। তার স্বামী রমজান আলী কৃষি কাজের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। তাদের পরিবার গ্রামে সচ্ছল বলেই পরিচিত।

সালেহা বলেন, বছর খানেক আগে তিনি গ্রিন হাউজের ওপর সাত দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তার স্বামী একই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। দুজনে ৩ হাজার টাকা করে পান। টাকা দেওয়া হবে জেনেই তারা প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন। তবে গ্রিন হাউজ পাননি। গ্রিন হাউজ না দেওয়ার এ ঘটনা জিও-এনজিও’র যৌথ উদ্যোগের প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্পে অনিয়মের একটি উদাহরণ। করোনাকালে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি ও স্বাবলম্বী করে তোলার নামে এমন ২১টি প্রকল্পে সমাজসেবা অধিদপ্তর ৫০৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ, ৮টির কাজ চলছে। তবে শেষের পথে।

তিন মাস ধরে ৫টি প্রকল্প নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও সুফলভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের অনেক ক্ষেত্রেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। প্রকল্পগুলোকে দেওয়া স্বল্পমেয়াদি ও নামকাওয়াস্তের প্রশিক্ষণ কাজে লাগেনি বলে স্বীকার করেছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই। কোনো কোনো এনজিও বাছাইয়ে অভিজ্ঞতার শর্তও মানা হয়নি। কোনো কোনো প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করেছে বিভিন্ন এনজিও। এসব এনজিও’র কোনো কোনোটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন রাজনীতিক, সাবেক আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, চলচ্চিত্রের অভিনেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ বলছেন, খাতিরের কারণে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তারপর ইচ্ছামতো অনিয়ম করা হয়েছে। উল্লেখিত উন্নয়ন কাহিনি পত্রিকাটির সূত্রে পাওয়া। তৃণমূলে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কী দশায় আছে, তার একটি অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় প্রথম আলোর কেইস স্টাডিগুলো থেকে। বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীত মহিলাদের নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজসাধ্য কোনো বিষয় নয়। যারা বাংলাদেশের সমাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা বোঝেন এবং জানেন নারীদের মধ্যে বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীতরা খুবই সংবেদনশীল অবস্থায় দিনাতিপাত করেন।

বিধবা হওয়ার পর গ্রামীণ গরিব নারীদের ঠাঁই কোথায় হয় সেটা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। বিত্তবান পরিবারের বিধবারা স্বামীর বাড়িতে থেকে যেতে পারেন। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের বিধবারা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়ে যায়। নিজ স্বামীর পরিবারে তার ঠাঁই নাও হতে পারে। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা মহিলার সন্তানরা অনেক সময় দাদার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে এরকম দরিদ্র মহিলাকে নিজ পিতার সংসারেও অনেক ক্ষেত্রেই ঠাঁই দেওয়া হয় না। একজন স্বামী-নিগৃহীত মহিলা আরও ক্ষমতাহীন। তার সংসার টিকে আছে বলে কাছের আত্মীয়দের কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পায় না। স্বামীর সংসারে তার অবস্থা অনেকটাই অবাঞ্ছিতের মতো। এ ধরনের নারী নিয়ে উৎপাদনমূলক বা উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। কাজটি অত্যন্ত কঠিন। এরকম নারীকে সম্মানজনকভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যে সমাজে এ রকম মহিলা বাস করেন, সেই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পালটে দেওয়ার জন্য সচেতনতামূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। আলোচ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসাবে সামাজিক সম্পর্কের বাধাগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে এবং সেসব বিবেচনা প্রকল্প প্রণয়নে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

প্রশিক্ষণসংক্রান্ত এসব প্রকল্প অনুমোদনের জন্য সেগুলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ওঠেনি। কারণ, ৫০ কোটি টাকার নিচে ব্যয়ের প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রীই অনুমোদন দিতে পারেন। করোনাকালে ‘লকডাউনের’ মধ্যে অনলাইনে পিইসি সভা করে প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলেছে, যেসব এনজিও প্রকল্প পেয়েছে, তাদের বেশিরভাগের চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদক অথবা মূল ব্যক্তি সরকারের কোনো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ। তাদের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। সরকারের দৃষ্টিতে এখন ৫০ কোটি টাকা তেমন কোনো টাকা নয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। তাই এ পরিমাণ টাকা বণ্টনের প্রক্রিয়াগুলো রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষগুলোর মূল্যায়নের অধীনে ন্যস্ত করা হচ্ছে না। পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনে এটি এখন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। গ্রামাঞ্চলে দলীয় আনুগত্য নিশ্চিতকরণে এর চেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার আর কী হতে পারে!
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/702758