৩ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:০২

তিনি ভয় পেয়েছেন

-ড. আবদুল লতিফ মাসুম

ভীতি থেকে স্বাধীনতা মৌলিক মানবাধিকারের অনিবার্য অংশ। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণার স্বীকৃত বিষয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট কথাটি প্রথম উচ্চারণ করেন। ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ বক্তৃতায় তিনি জাতিসমূহের মৌলিক নীতি হিসেবে এর উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে জাতিসঙ্ঘের ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন ঘোষণায় বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়। জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মৌলিক মানবাধিকার ঘোষণার শুরুতেই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়।

সেই থেকে বিশ্বের সর্বত্র গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তথা মানবাধিকারের অনিবার্য বিষয় হিসেবে এটি গৃহীত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভীতি থেকে স্বাধীনতাকে সংবিধানের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় ভীতি থেকে স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ‘থিউরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ বা তত্ত্ব ও বাস্তবতা বলে কথা আছে না! গোয়ালের গরু কেতাবে আছে খোঁয়াড়ে নেই। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো- যারা এসব ভালো ভালো কথা লিখেছেন, তারাই মন্দ মন্দ কাজগুলো করেছেন। বিনা বিচারে গ্রেফতারের জন্য তারা স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট করেছে- পরবর্তীকালে সংবিধানের খোল-নলচে পাল্টে দিয়ে বাকশাল কায়েম করেছে। ২১ বছর পর একই দল যখন আবার ক্ষমতায় এসেছে, তখন প্রীতির পরিবর্তে তারা ভীতির সৃষ্টি করেছে। তাদের এই অন্যায় অপকর্মের তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা নিয়ে বড় গ্রন্থ রচনা করা যায়। তাদের সর্বশেষ কীর্তি ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাক্ট-২০১৮ এর নিকৃষ্টতম প্রমাণ।

বিগত প্রায় ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ শক্তির শাসনের মাধ্যমে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। বিএনপি প্রধান দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। বিএনপির পরবর্তী নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একই ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে আজীবন জেলের শাস্তি দেয়। এই কলাম লেখার সময় তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে মামলায় শাস্তি দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক ওই মামলা করেছে। হত্যা, গুম, মামলা ও হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি বড় জেলখানায় পরিণত করেছে তারা।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সারা দেশে দলটির নেতাকর্মীদের নামে যেসব মামলা হয়েছে, তার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এসব মামলায় আসামি ৩৬ লাখ। আর কারাগারে আটক ২০ হাজার। ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর নতুন করে মামলা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি বিশাল। জামায়াতের একাধিক নেতা জানান, ১৪ বছরে জামায়াতের বিরুদ্ধে ১৬ হাজার মামলা দেয়া হয়েছে, আসামি প্রায় ১৬ লাখ নেতাকর্মী। ৪৯৬ জন খুন হয়েছে। অন্যান্য বিরোধী দলের অবস্থাও একই রকম। স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে মধ্যরাতে রক্তপাত ঘটায়। সেখানে হতাহত সম্পর্কে আজো কোনো পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে গিয়ে হেফাজতে ইসলাম দ্বিতীয়বার সরকারের রোষানলে পড়ে। এখনো হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য দলের অনেক আলেম-ওলামা জেলে রয়েছেন। চরম ভীতি সৃষ্টি করে জনপ্রিয় ওয়ায়েজিনদের দেশছাড়া করা হয়েছে। তাদের কণ্ঠকে হামলা-মামলার মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এসব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রথম থেকেই আন্দোলন করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি তথা বিরোধীদলীয় আন্দোলন তীব্রতা অর্জন করায় তাদের ভীতির রাজত্বের কৌশল মাত্রা ছাড়িয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গুলি, আগুন, গ্রেফতার আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। এ সময় ঢাকার রাজপথে রক্তের হোলি খেলা চলে। মুহুর্মুহু গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, ককটেল, আগুন আন্দোলনকে চরম অবস্থার দিকে টেনে নেয়। ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেই সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিএনপির ওপর বিভিন্ন পয়েন্টে হামলা চালায়।

পুলিশের হামলা ও লাঠিপেটার শিকার হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়সহ অনেকে। গয়েশ্বর রায়ের ঘটনাটি ঘটে পুরান ঢাকায়। ধোলাইখালে ওইদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। প্রথমে পুলিশের ধাওয়ায় বিএনপি নেতাকর্মীরা পিছিয়ে যায়। পরে বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশকে ধাওয়া দেয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আহত হন। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। পুলিশ সদস্যরা জানান, গয়েশ্বরকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে পুলিশ। একপর্যায়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। সে অবস্থায়ও তাকে লাঠিপেটা করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ধোলাইখাল এলাকা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয় পুলিশ।

অপর দিকে, আরেকটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে গাবতলীতে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা সোয়া ১১টার দিকে খালেক বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আমান উল্লাহ আমানের নেতৃত্বে বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। ওই সময় তাদের চারপাশে ছিলেন পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সড়কে অবস্থান নেয়ার পর পুলিশের সাথে অন্তত ১০ মিনিট বাগবিতণ্ডা চলে আমান উল্লাহ আমানের। ওই সময় আমান বলেন, ‘আমি চারবারের এমপি ছিলাম। আমি জানি কোন আইনে কী করতে হয়। আমরা আইন মেনেই এখানে অবস্থান নিয়েছি। আমরা কোনো সড়ক অবরোধ করিনি।’

বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে আমানের পাশে বিএনপির আট থেকে ১০ নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে আমানকে গাড়িতে করে নিয়ে যেতে চাইলে সড়কে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিনি। ওই সময় পুলিশের এক সদস্য তাকে বলেন, ‘এখানে মিডিয়ার সামনে আপনি অভিনয় করবেন না প্লিজ। আপনি আমাদের গাড়িতে উঠুন।’ পুলিশের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমান কোনো সাড়া না দেয়ায় তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। ওই সময় এক পুলিশ সদস্য বলেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমানকে গাড়িতে ওঠানোর সময় সাঁজোয়া যান, জলকামান নিয়ে সড়কে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যকে অবস্থান করতে দেখা যায়।

এসব নিয়ে পুলিশের সাথে হামলার ঘটনা ঘটে। বাসে আগুন জ্বলে। এসব ঘটনায় ১৭টি মামলা করে পুলিশ। নাম উল্লেখ করে বিএনপির ৭৫৬ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। গ্রেফতার করা হয় সাত শতাধিক। রিমান্ডে নেয়া হয় ২৮ জনকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রেফতারের সংখ্যা স্বীকার করেছেন। এ ছাড়াও অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা হাজার হাজার। এ ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে শেষ রক্ষা করতে চাইছে ক্ষমতাসীনরা। তারা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টিতে কতটা নির্মম হতে পারে এ ঘটনা দুটোই তার প্রমাণ। পরবর্তীকালে সরকার ম্যাকিয়াভেলি কৌশলে যে রাজনৈতিক তামাশা দেখিয়েছে তা বাংলার এই পুরনো প্রবাদবাক্যকে ‘গরু মেরে জুতা দান’ মনে করিয়ে দেয়।
বিরোধী দলের ক্রমাগত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এখন প্রান্তিক পর্যায়ে। ফুঁসে উঠছে জনগণ। ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে জনগণের রোষ কিছুটা হলেও প্রতিভাত হয়েছে। এতেই ভয় পেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশবাসীর ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। আন্দোলন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। সামান্য আন্দোলন দেখে ভয় পাবেন না। যতক্ষণ জনগণ আমাদের সাথে আছে, ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই। আমরা অগ্নিসংযোগ-সন্ত্রাসকে আর বরদাশত করব না।’ জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস উপলক্ষে রাজধানীর উসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পুরস্কার-২০২৩’ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

তিনি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য কাজের জন্য ২৮ কর্মকর্তা ও দু’টি সরকারি দফতরকে পুরস্কার দেন। আমার জানামতে, বিগত ১৫ বছরে এরকম ভয় পাওয়ার বা না পাওয়ার কথা বলেননি তিনি। মানুষ অবচেতন মনে অনেক সময় মনের কথা বলে ফেলে।

মনস্তত্ত্ববিদদের তত্ত্ব মোতাবেক- আসলেই তিনি ভয় পেয়েছেন। গণভবন থেকে চলে যেতে হলে কোথায় উঠবেন, সে কথাও বলেছেন। ওই অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জানা যায়, উপস্থিত সব কর্মকর্তার মুখে ছিল ভীতি ও মানসিক উদ্বেগ। প্রধানমন্ত্রী হয়তো বা তা দেখেই ওইসব কথা বলেছেন। রাজনীতির রণকৌশল বলে, আঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি করে সেটিই স্বাভাবিক। এক সময় সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যায়। সভ্যতার ইতিহাসে কোনো রাজা-রাজ্য-রাজধানী চিরস্থায়ী হয়নি। স্থায়ী হয়েছে- সুনাম, সুখ্যাতি ও জনস্বার্থ।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র মোতাবেক- ‘Every action (force) in nature there is an equal and opposite reaction. If object A, exerts a force on object B, object B also exerts an equal and opposite force on object A. In other words, forces result from interactions.’ প্রতিটি কর্মেরই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। রাবিন্দ্রিক ভাষায়- ‘সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাদের আমি’। আপনি পূর্বে যে কর্ম বা কার্যকলাপ করেছেন- তাই আপনাকে বর্তমানে মোকাবেলা করতে হবে। কবির ভাষায়- ‘পাপে পাপ আনে পুণ্যে আনে সুখ’। আরো বলা যায়, প্রতিটি জিনিসই তার মূলের দিকে ধাবিত হয়। আপনার মূল যদি হয় শক্তি, শঠতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা ও অন্যায়-অত্যাচার, তাহলে সে পথেই আপনাকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/766823