২ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৫:২৭

পদে নেই, তবু দলনেতা সেজে জার্মানি সফর!

অতিরিক্ত সচিব তানজিয়ার ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্ষোভে ফুঁসছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) উম্মে সালমা তানজিয়ার বিদেশ সফর নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। ই-পাসপোর্টের একটি প্রশিক্ষণে তিনি দলনেতা হিসাবে জার্মানিতে ৫ দিন সফর করেন। গতকাল তার দেশে ফেরার কথা।

এদিকে তার এ প্রশিক্ষণ পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কোনো কাজে আসবে না। কারণ তিনি এখন ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে কর্মরত। সম্প্রতি তাকে পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে এখানে বদলি করা হয়।

সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলছেন, প্রথমত নীতিগত কারণে এ সফরে উনার যাওয়াই ঠিক হয়নি। দ্বিতীয়ত, যারা এভাবে তাকে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তারাও এর দায় এড়াতে পারবেন না। কারণ যে কর্মকর্তা পাসপোর্টে কর্মরতই নেই, অথচ তাকে টিম লিডার করে জার্মানিতে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগকে আগেই এ সংক্রান্ত জিও বাতিল অথবা সংশোধন করা জরুরি ছিল। কিন্তু যথাসময়ে এটি করা হয়নি।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাসপোর্টে বদলি হয়ে আসেন তানজিয়া। দেড় বছর কর্মরত থাকার পর ২ জুলাই তাকে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে বদলি করা হয়। নতুন কর্মস্থলে বদলির অন্তত ২০ দিন পর ২৩ জুলাই তিনি পাসপোর্ট সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিতে জার্মানি চলে যান।

ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ার পর পাসপোর্টের কর্মকর্তা সেজে তার এই বিদেশ সফর খুবই আপত্তিকর ও দৃষ্টিকটু। তাছাড়া বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিদেশ থেকে তিনি যে জ্ঞান আহরণ করবেন তা পাসপোর্টের কোনো কাজেই লাগবে না। কারণ ইতোমধ্যে তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে পাসপোর্টের কারিগরি বিভাগের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাঠানো হলে অধিদপ্তর উপকৃত হতো।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, প্রথমত পাসপোর্ট থেকে বদলি হওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নাম জিও (সরকারি আদেশ) থেকে বাতিল করা উচিত ছিল। কারণ বিদেশ সফর থেকে অর্জিত প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা যদি সরকারের কাজে না লাগে তবে সবই বৃথা। দ্বিতীয়ত, সরকারি সফরে কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের উদাহরণ অবশ্যই খারাপ নজির সৃষ্টি করে।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ‘এডিজি হিসাবে ম্যাডাম আমাদের সব সময় নীতি বাক্য শোনাতেন। অথচ এভাবে বিদেশ সফরে যুক্ত হয়ে তিনি নিজেই গুরুতর অনিয়ম করেছেন।’ কিন্তু এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করার কেউ নেই।

অপর এক পাসপোর্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘ম্যাডাম কতটা ভালো ছিলেন তা বলতে পারবেন সহকারী পরিচালক রুবায়েত ফেরদৌস। কারণ অধিদপ্তরে ম্যাডামের স্নেহভাজন হিসাবে যারা পরিচিত ছিলেন রুবায়েত তাদের অন্যতম। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক কিছুই জানা যাবে।’

৩১ মে জারিকৃত এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশে (জিও) জার্মানিতে ই-পাসপোর্ট সংক্রান্ত প্রশিক্ষনের জন্য ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চূড়ান্ত করা হয়। সফরকারী দলের টিম লিডার অতিরিক্ত সচিক উম্মে সালমা তানজিয়া। ৫ দিনের সফরে ই-পাসপোর্ট তৈরি ও বিতরণসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া কথা। এর আয়োজক ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়নকারী জার্মান প্রতিষ্ঠান ভেরিডোজ জিএমবিএইচ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের আওতায় প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ নিচ্ছেন। বিশেষ করে চাপের মুখে মন্ত্রণালয়ের কমকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন দেশে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম উদ্বোধনের জন্য কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোক দরকার। কিন্তু বাস্তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া এক রকম বাধ্যতামূলক।

এক পাসপোর্ট কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিদেশ সফরের সুযোগ না পেলে পদে পদে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। দাপ্তরিক ফাইল মন্ত্রণালয়ে গেলে অহেতুক কোয়ারি দেওয়া হয়। এমনকি যে নথিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন তাও আটকে থাকে। তাই ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়েই পাসপোর্টের বিদেশ সফর টিমে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের রোটেশন করে সুযোগ দেওয়া এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

সূত্র বলছে, বর্তমানে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের ব্যয় লাফিয়ে বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় লোকবলের বিদেশ সফর। প্রকল্পের সংশোধিত বরাদ্দ (আরডিপি) পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরও খোলাসা হবে। কারণ ইতোমধ্যে প্রকল্পের মূল বরাদ্দ ব্যয় এখন প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছাছে।

বক্তব্য : জার্মানি সফর প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব উম্মে সালমা তানজিয়া রোববার যুগান্তরকে বলেন, সফর সংক্রান্ত সরকারি আদেশ যখন জারি হয় তখন তিনি পাসপোর্টের ডিজি হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করায় বিদেশ যেতে পারেননি। পরে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে পোস্টিং হয়। নতুন কর্মস্থলে অল্প কিছুদিন আগে যোগদান করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বিভাগীয় কমিশনার হলেও এ প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞান তিনি মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগাতে পারবেন। মাঠ পর্যায়ের পাসপোর্ট অফিসগুলোতে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন। শেখার কোন বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণের আওতা আরও বিস্তৃত করা উচিত।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/702355