২ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৫:১৫

নির্বাচন নিয়ে নোংরামি শুরু

মুজতাহিদ ফারুকী

১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ভাষাতত্ত্ব সমাজ, বাংলাদেশ বাংলা শিক্ষক সমিতি ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ যৌথভাবে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি বক্তৃতামালা’র আয়োজন করে। সেখানে দেশের সেরা গবেষক, বিশেষজ্ঞরা প্রবন্ধ পড়েন এবং আলোচনায় অংশ নেন। প্রবন্ধের বিষয় ছিল বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ, বাংলার সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। সদ্য স্বাধীন একটি দেশে স্বজাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গভীর আত্মসন্ধানমূলক ওই আলোচনা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাতে সন্দেহ নেই। সেখানে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ‘বাঙালি জাতি’ শিরোনামে একটি সুদীর্ঘ ও সুলিখিত প্রবন্ধ পড়েছিলেন। প্রবন্ধে তিনি বাঙালির চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেন, ‘বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেশী এবং বিদেশী সব ঐতিহাসিকই মূলত দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এক. বাঙালি কল্পনা-প্রবণ, ভাবালু, সৌন্দর্যানুরাগী, স্পর্শকাতর, দুর্বলচিত্ত, আরামপ্রিয়, অলস, চিন্তাশীল, ভাবুক, কবি-স্বভাব, ইত্যাদি। দুই. বাঙালি কলহপ্রিয়, ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, অদূরদর্শী, ভীরু, সাহসহীন, স্ত্রীস্বভাব, হুজুগে ইত্যাদি। প্রথমটি বাঙালির গুণের দিক আর দ্বিতীয়টি দোষের দিক হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।’
প্রবন্ধকার বলেছেন, প্রথমটি গুণের দিক হিসাবে বর্ণিত। আমাদের জানা নেই, দুর্বলচিত্ত, আরামপ্রিয়, অলস এগুলোও কী করে গুণবাচক বৈশিষ্ট্য হতে পারে। তবে একেবারে শেষে গিয়ে প্রবন্ধকার একটি মূল্যবান মন্তব্য যোগ করেন। বলেন, ‘আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য অমোঘ নিয়তির মতো কোনো দুর্লঙ্ঘ্য ব্যাপার নয়; জাতীয় সাধনা ও জাতীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব এবং পৃথিবীর অনেক জাতি তা করতে সক্ষমও হয়েছে।’
শেষের কথাটি সত্য। ইসলামের আবির্ভাবের আগে যে আরব জাতি ছিল অসভ্য, বর্বর, তারাই কিভাবে সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে গোটা বিশ^সভ্যতার আলোর দিশারি হয়ে ওঠে তা মুসলমানদের অনেকে না জানলেও কেউ কেউ তো জানেন। আর এক সময়ের নোটোরিয়াস ইউরোপ কিভাবে দৃশ্যত আজকের সভ্য জগতের উদাহরণ হয়ে উঠেছে তাও সবার জানা।

কিন্তু সমস্যা হলো, বাঙালির চরিত্রে সভ্যতার ছোঁয়া কতটা লেগেছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সন্দেহের কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণে নিহিত। বাঙালি কলহপ্রিয়, ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, অদূরদর্শী, ভীরু, সাহসহীন, স্ত্রীস্বভাব, হুজুগে এসব দোষগুলোর কোনোটি কি দূর হয়েছে? ইতিহাস সচেতন কেউ হয়তো বলবেন, জাতি হিসাবে আমরা নবীন। বয়স হাজার বছরও পূর্ণ হয়েছে কিনা সংশয়। জাতীয় চরিত্র পাল্টাতে শত শত বছর লেগে যেতে পারে। ঠিক কথা। তবে এ জন্য সাধনা ও সংগ্রামের দরকার আছে, যেটি বলেছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। সেই সাধনার ছিটেফোঁটাও কি কোথাও দৃশ্যমান? আমাদের শিক্ষায়, জীবনযাপনে, রাজনীতিতে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে কোথাও কি জীবনকে সুন্দর করার, উন্নত করার, মহত্তর করে তোলার সামান্য আয়োজনও আছে? হ্যাঁ, ছিল একসময়। আমাদেরই লেখকেরা এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। কিন্তু এখনকার কোনো তরুণকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন তো, ডা: লুৎফর রহমানের ‘উন্নত জীবন’, ‘মহৎ জীবন’ বা অন্য কোনো বই পড়েছে কিনা! পড়েনি। পড়তে দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি? এখানেই আসে রাজনীতির প্রশ্ন। রাজনীতিকরা শুধু গোষ্ঠীগত স্বার্থ দেখেছেন। জাতীয় স্বার্থ নয়।
স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল বা আছে আওয়ামী লীগ। প্রায় সাড়ে ২৩ বছর। বিএনপি ১৩ বছর। জাতীয় পার্টি নয় বছর। এই সময়ের মধ্যে আমাদের পুরনো সব মূল্যবোধ ধ্বংস হয়েছে নানাভাবে। জাতীয় কোনো চেতনা, সংহতির এমন কোনো একটি কেন্দ্র কিংবা নিছক দেশপ্রেমের এমন কোনো বোধ রাজনীতিকরা দিতে পারেননি যা দলমত নির্বিশেষে সবাই ধারণ করে। বরং তারা অনৈক্য ও বিরোধ উসকে দিয়েছেন। কখনো স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের নামে, কখনো প্রগতিশীলতার নামে। মোট কথা, আমাদের সামনে জাতীয় চরিত্র পাল্টে ফেলার কোনো সাধনা বা সংগ্রামের আদর্শ নেই।

আজ নির্বাচনের প্রসঙ্গে বলতে এসে জাতীয় চরিত্র নিয়ে টানাটানির কারণ, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কাণ্ডকীর্তি। এসব কর্মকাণ্ডে জাতীয় চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্যটি ফুটে ওঠে সেটি পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য। গত ১৫ বছর ধরেই বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বৈধতার সঙ্কট আছে। তারা নানা কৌশলে ক্ষমতা দখল করে আছেন। শুধু তাই নয়, আগামী নির্বাচনও তাদের ইচ্ছামতো করার জন্য যা ইচ্ছা তাই করছেন। ২০১৮ সালে নজিরবিহীন নৈশভোটে ক্ষমতা ছিনতাইয়ের পর যেভাবে তার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, এবারও সেই একই কৌশল নিয়েছেন।

দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে রাতভর ধর্ষণের বৈধতা দিয়েছিলেন এক মাওলানা। মাওলানা মোহাম্মদ আবেদ আলীর সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন ও ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল তা ২০১৯ সালের পহেলা জানুয়ারি পত্রিকায় প্রকাশ পায়। তারা বলেছিল, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ হয়েছে এবং এ নির্বাচন ছিল বিশে^র বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের মতো। এটি অন্য গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

নামে সার্ক এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের অনুরূপ লোগো ব্যবহার করলেও মূলত সার্কের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মাওলানা মোহাম্মদ আবেদ আলী একাই সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এবং ও ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের চেয়ারম্যান। দুটি প্রতিষ্ঠানই মূলত তার। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে কাজ করেন এবং এতে যৎসামান্য ফায়দা পান।

এবার আসুন, জেনে নিই ‘বিদেশি পর্যবেক্ষক’ বলে যাদের তিনি গত নির্বাচনে এনেছিলেন তাদের পরিচয়। না, আমরা কোনো নেচুফেচু নেড়ি গণমাধ্যমের বরাত দেব না। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের রিপোর্ট থেকে দেখতে চাইছি। ২০১৮-র ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়েছিল। আর রয়টার্স এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে ২৭ জানুয়ারি ২০১৯। শিরোনাম ছিল এরকম, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ গ্রুপের কিছু সদস্য তাদের সংশ্লিষ্টতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।’

রিপোর্টে বলা হয়, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী কানাডার নাগরিক তানিয়া ফস্টার এবং তার মেয়ে ক্লোয়ে ফস্টার এর আগে আর কোনো জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক করেননি। বাংলাদেশে একটি গ্রুপ বিদেশী পর্যবেক্ষণ খুঁজছে, স্থানীয় বাংলাদেশীদের কাছে এমনটা জেনে তিনি ও তার মেয়ে নিছক ব্যাপারটা মজার হবে ভেবেই আবেদন করেন এবং অনুমতি পেয়ে যান। মূলত বেড়ানোর সুযোগ নিয়েছিলেন। কানাডার সাসকাচুন প্রদেশের সরকারি কর্মচারী ফস্টার বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে ভালো বোধ করছি না, মনে হচ্ছে নির্বোধের মতো কাজ করেছি।’ ফস্টার এমনও বলেন, ‘আমরা শুধু ঢাকা শহরের কয়েকটি কেন্দ্র দেখেছি।’ কিন্তু নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে এই ফস্টারই সবার আগে মাইক্রোফোন নিয়ে নির্বাচন সম্পূর্ণ সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান।

আর সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম রয়টার্সকে বলেন, সবকিছু জানার পর এখন আমি বলতে পারি, নির্বাচন সুষ্ঠু অবাধ হয়নি। আবদুস সালাম হাইকোর্ট ডিভিশনের সাবেক বিচারপতি। প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টামণ্ডলীর চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের এমপি ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী। আর প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় গত নির্বাচনের পর এই পর্যবেক্ষণ সংস্থার বক্তব্য বিবৃতি বারবার টুইট করেছেন বলে রয়টার্স জানাচ্ছে। তবে সংগঠনটি যে, আওয়ামী লীগের লেজুড়, তাতে সন্দেহ নেই।

এখন দ্বাদশ নির্বাচনের আগে ওই লেজই নাড়াচ্ছে সরকার। আবার সেই একই প্রক্রিয়ায় চারটি দেশ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এনে হাজির করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নাম পরিচয়হীন পর্যবেক্ষকরা এরই মধ্যে বলেছেন, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অসাংবিধানিক ও বেআইনি। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে, এটাও তারা জেনে ফেলেছেন।
জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি বিষয় নিয়ে যারা এমন জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিতে পারে তারা বাঙালি জাতির চরিত্রের কোন দোষটি শুধরে নেয়ার জন্য জাতীয় সাধনা ও সংগ্রাম করছে, কেউ বলতে পারবেন?
mujta42@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/766571