২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৭:৩৬

পানির জন্য হাহাকার

আঁশটে গন্ধ, ঘোলাটে রঙ। কে মানবে, এই পানি ফিল্টার করা হয়েছে! শেষমেশ রেস্টুরেন্টের মালিক মরিয়া হয়ে দেখালেন, 'ওই যে_ ওই যে দেখুন, কোনায় দুটো ফিল্টার রাখা আছে।' একপর্যায়ে এর প্রমাণ দিতে তিনি ট্যাপ থেকে সরাসরি এক গ্গ্নাস পানি নিয়ে এলেন। দেখা গেল, এ পানির রঙ আরও বেশি ঘোলাটে। আর গ্গ্নাস ঠোঁটের কাছে আনার আগেই বোটকা গন্ধে মুখ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। শুধু রেস্টুরেন্টেই নয়, শহর ঘুরে শিক্ষার্থী, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, গৃহবধূ_ সবার সঙ্গে কথা বলতে

বলতে ফরিদপুর শহরের পানি সমস্যার ভয়ঙ্কর দিক আরও স্পষ্ট হলো। শহরবাসীর মতে, ফরিদপুর পৌরসভা থেকে সরবরাহ করা পানি পান করা দূরে থাক, অনেক সময় গোসলের জন্য ব্যবহার করতেও গা ঘিনঘিন করে।

ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র শেখ মাহতাব আলী মেথুও একবাক্যে জানালেন, শহরের প্রধান সমস্যাই হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। ভূগর্ভস্থ পানি শোধন করেও সাধারণভাবে ব্যবহারের উপযোগী করা যাচ্ছে না। অথচ ভূগর্ভের এ পানির স্তরও দিন দিন নিচে নামছে। তাই চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করাও প্রায়ই সম্ভব হয় না। তবে আশার কথাও শোনালেন তিনি, নতুন একটি শোধনাগার নির্মাণের পথে; আরও একটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ শোধনাগারে সরাসরি পদ্মা থেকে পানি নিয়ে আসা হবে। এ দুটি শোধনাগার চালু হলে বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটবে।

পানির অবস্থা এমন কেন? :পানির অবস্থা এমন কেন ফরিদপুর শহরে? এর একটা ব্যাখ্যা দিলেন ফরিদপুরে দায়িত্বপ্রাপ্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আহমেদ। তিনি জানালেন, এখানকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আয়রন অনেক বেশি।

পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা অবশ্য জানালেন, ফরিদপুর শহরে পানি সরবরাহের জন্য বর্তমানে দুটি শোধনাগার আছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বছরের পুরনো প্রথম শোধনাগারটি সত্যিকার অর্থে পানি শোধন করতে পারছে না। এ ছাড়া এর পানি সরবরাহ লাইনও পুরনো হয়ে গেছে; পুরু হয়ে পড়েছে ময়লার স্তর। ফলে শোধনাগার থেকে শহরের ভেতর গ্রাহকের কাছে যাওয়ার পথে সরবরাহ লাইনেই দূষিত হয়ে পড়ছে পানি।

সরেজমিনে প্রথম শোধনাগারটি ঘুরে কর্মকর্তার কথার সত্যতা পাওয়া গেল। শোধনাগার থেকে শোধন হয়ে বের হওয়া পানির রঙই স্বচ্ছ নয়। আর শোধনাগারের ভেতরে যে পানি ঢুকছে, তার চেহারা তো আরও ভয়ানক! মনে হচ্ছে, হলুদের মতো কোনো রঙ পানিতে খুব করে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও এর মূল কারণ অতিরিক্ত আয়রন।

দ্বিতীয় পানি শোধনাগারটি খুব বেশি পুরনো নয়। এর কারিগরি প্রকৌশল দিকও বেশ আধুনিক। অথচ এ শোধনাগার থেকে বের হওয়া পানিও পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়।

শোধনাগার থেকে পাম্পে গিয়ে দেখা গেল, পানি তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সবাইকে। কর্তব্যরত একজন জানালেন, গত চার-পাঁচ বছরে পানির স্তর ২০-৩০ ফুট নেমে গেছে। প্রায়ই পাম্পে পানি আসে খুব কম। একসময় এখানে এক ঘণ্টায় এক হাজার ঘনমিটার পানি উঠত। এখন ৫০০ থেকে ৬০০ ঘনমিটারের বেশি পানি তোলাই যাচ্ছে না। পানির স্তর যত নামছে, তত বেশি ঘোলা পানি উঠছে বলে জানালেন কর্মরত কর্মকর্তারা।

অর্ধেক মানুষের কাছে পানি পেঁৗছায় :ফরিদপুর পৌরসভার পানি সরবরাহ-সংক্রান্ত নথি অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বর্তমানে শহরের ৫৫ শতাংশ মানুষ পানি সরবরাহের আওতায় রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের অভিমত, ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ মানুষ পৌরসভার সরবরাহ করা পানি পায়। বাকিদের নির্ভর করতে হচ্ছে স্ব-উদ্যোগে স্থাপন করা গভীর নলকূপের ওপর। অবশ্য গভীর নলকূপ থেকে যে পানি তোলা হচ্ছে, সে পানির চেহারাও মলিন, ঘোলা। পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়ায় মূল শহর এলাকায় অগভীর নলকূপ দিয়েও পানি ওঠে না বললেই চলে।

পৌরসভার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৪টি পাম্পের মধ্যে তিনটি নষ্ট। অর্থাৎ ১১টি পাম্প দিয়ে প্রতিদিন আট হাজার ৭৫৪ ঘনমিটার পানি তোলা হচ্ছে। শহরের ভেতরে ১৪৪ কিলোমিটার সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে পানি। এর মধ্যে ১২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটার, আট ইঞ্চি পাইপের দৈর্ঘ্য ২২ কিলোমিটার, ছয় ইঞ্চি পাইপের দৈর্ঘ্য ৪৬ কিলোমিটার, চার ইঞ্চি পাইপের দৈর্ঘ্য ৬৭ কিলোমিটার ও তিন ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের দৈর্ঘ্য আট কিলোমিটার।

পৌরসভার এক কর্মকর্তা জানান, আসলে বর্তমানে পানির চাহিদা ১৫ হাজার ঘনমিটারের বেশি। তবে প্রতিদিনই পাম্পে পানি কম ওঠার কারণে চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ব্যবধান বাড়ছে। আগে আট ঘণ্টা পাম্প চালিয়ে মোটামুটি সারাদিনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যেত। অথচ বর্তমানে ১২ ঘণ্টা পাম্প চালিয়েও তা পূরণ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, 'সরবরাহ লাইনে নতুন করে বড় ব্যাসের পাইপ স্থাপন করা দরকার। সরবরাহ পাইপ লাইনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাসের হওয়ায় পানি সরবরাহও মসৃণ হচ্ছে না। তা ছাড়া ময়লার স্তর পড়ে পানিও দূষিত হচ্ছে।

উপরিভাগের পানি ব্যবহারের বিকল্প নেই :ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র শেখ মাহতাব আলী মেথু জানান, তার সামনে এখন চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহই বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি জানান, পানি সংকট সমাধানে এরই মধ্যে নতুন আরেকটি পানি শোধনাগার নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধানে এর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পদ্মার পানি পাইপে করে নিয়ে এসে শোধন করে শহরে সরবরাহের জন্য আরও একটি শোধনাগার নির্মাণের প্রকল্প এরই মধ্যে একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। মেয়রের অভিমত, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে উপরিভাগের পানি ব্যবহারের বিকল্প নেই। আর তা আনার সহজতম উপায় শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা। এক বছরের মধ্যেই এই শোধনাগার নির্মাণ সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করেন।

ফরিদপুরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আহমেদ বলেন, 'ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে নির্মাণাধীন নতুন শোধনাগারের কাজ শেষ পর্যায়ে। এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই তা পৌরসভাকে হস্তান্তর করা হবে। এ শোধনাগার থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ ঘনমিটার পানি শোধন করে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।'

দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, পদ্মা থেকে পানি নিয়ে এসে সরবরাহের জন্য নির্মাণাধীন শোধনাগারে বেশি পানি শোধন করা যাবে। এর নির্মাণ সময়সাপেক্ষ ও অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। এটি নির্মাণ হলে প্রতি ঘণ্টায় ৭০০ ঘনমিটার পানি শোধন সম্ভব হবে। এটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা।

http://bangla.samakal.net/2017/04/21/286770#sthash.P3KCj3HA.dpuf