ছাপরা ঘর। মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। বৃষ্টি এলেই পানি পড়ে। সন্ধ্যার পর কেরোসিনের ক্ষীণ সলতের কুপিবাতি জ্বলে নিভু নিভু করে। সলতে বাড়িয়ে দিলে তেল না আবার দ্রুত ফুরিয়ে যায়! তেল ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে রাত ৮টার পরই নিভিয়ে ফেলা হয় বাতি। এমন দরিদ্র-জর্জরিত একটি সংসারে বিদ্যুতের আলো কল্পনামাত্র। সংগত কারণেই বিদ্যুৎ সংযোগ নেননি রিকশাচালক নূর ইসলাম। অথচ সেই বিদ্যুতের চার মাসের বিল বকেয়ার নামে বিনা দোষে তাঁকে খাটতে হয়েছে ১৩ দিনের কারাবাস। তিনি এখন অসুস্থ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
পুলিশের বাড়াবাড়ি ও ভুলের কারণে এই দুর্ভোগ পোহালেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মগটুলা ইউনিয়নের নাইড়ি গ্রামের নূর ইসলাম (২৫)। এ ঘটনার পেছনে কিছুটা ভুল ছিল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিরও। এ ঘটনায় ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩-এর আওতাধীন ঈশ্বরগঞ্জের উপ-আঞ্চলিক কার্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিলেও পুলিশের বাড়াবাড়ি রকমের ভুলের জন্য শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ভুলের জন্য দায়ী ঈশ্বরগঞ্জ থানার সহকারী উপপরিদর্শক (্এএসআই) মিজানুর রহমান। জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী ইকুরিয়াকান্দা গ্রামের বিদ্যুৎ গ্রাহক নূরুল আমীনের নামে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের জন্য মামলা করে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩-এর ঈশ্বরগঞ্জের উপ-আঞ্চলিক কার্যালয়। কিন্তু মামলা করার ক্ষেত্রে ভুলবশত আসামির নাম লিখা হয় নূর ইসলাম। অথচ প্রকৃত আসামির নাম নুরুল আমীন। দুর্ভাগ্য হলো দুজনের বাবার নাম এক। নাউড়ি গ্রামের রিকশাচালক নূর ইসলামের বাবার নাম মো. ছফির উদ্দিন। আর পাশের ইকুরিয়াকান্দা গ্রামের বিদ্যুৎ গ্রাহক নূরুল আমীনের বাবার নাম হলো ‘মৃত ছফির উদ্দিন’। পার্থক্য বলতে একজনের নাম নূর ইসলাম, আরেকজনের নাম নুরুল আমীন। নাউড়ির নূর ইসলামের বাবা জীবিত; কিন্তু ইকুরিয়াকান্দার নুরুল আমীনের বাবা মৃত। এর চেয়ে বড় পার্থক্য হলো দুজনের গ্রাম ভিন্ন এবং একজনের বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, অন্যজনের নেই। এমন পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পুলিশ বীরদর্পে অভিযান চালিয়ে বিদ্যুৎ মামলায় বিদ্যুৎ সংযোগহীন রিকশাচালক নূর ইসলামকে ধরে আদালতে চালান করে দেয়। গ্রামবাসী বলছে, পুলিশের অভিযান দেখে মনে হচ্ছে, সে দিন গ্রামে তারা বড় মাপের দুর্ধর্ষ কোনো অপরাধীকে ধরতে এসেছিল। প্রতিবেশীরা নাম যাচাই করতে এবং ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই এমন কথা বলার পরও পুলিশ কারো কথাই শুনতে চায়নি।
পল্লী বিদ্যুৎ অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইকুরিয়াকান্দা গ্রামের নুরুল আমীনের চার মাসের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। এ কারণে দীর্ঘদিন তাগাদা দেওয়ার পরও বিল না দেওয়ায় খেলাপি হিসেবে মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসে ঈশ্বরগঞ্জ থানায়। পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করতে গত ৯ মার্চ রিকশাচালক নূর ইসলামকে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ১৩ দিন কারাভোগের পর গত ২২ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান। এখন তিনি শারীরিক অসুস্থ হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন।
গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে বাড়িতে গেলে নূর ইসলাম বলেন, ‘বিনা দোষে ১৩ দিন জেল (কারাবাস) খাটছি। ওইহানো সময়মতো খাইতে ও ঘুমাইতে পারছি না। চিন্তা করছি কেরে আমি জেলো আইয়ালাম। কী অপরাধ করছিলাম আমি। ’ নূর ইসলামের ছোট বোন রুমা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ৯ মার্চ ঈশ্বরগঞ্জ থানা থেকে দুজন পুলিশ এসে নূর ইসলামকে পেয়েই টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলে যায়। ’ রুমা বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ নামানোর মতো আর্থিক সংগতি তাঁদের নেই। মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন না বলে আশপাশের গ্রাহকরা তাঁদের পার্শ্ব সংযোগ দিতে চাইলেও তা নেননি। তার পরও তাঁর ভাইকে বিদ্যুৎ বিলখেলাপি মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।
গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, পুলিশের ভাবগতিক দেখে সেদিন মনে হয়েছিল তারা যেন এই গ্রামে ভয়ংকর কোনো আসামির সন্ধান পেয়েছে। প্রতিবেশী মো. শামসুদ্দীন মিয়া (৭০) অভিযোগ করে বলেন, একটু কথা বলার মতো সুযোগ দেয়নি পুলিশ। এমনকি ভোটার পরিচয়পত্রের কাগজ দেখতেও চায়নি।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করতে যাওয়া সহকারী উপপরিদর্শক (্এএসআই) মিজানুর রহমান বলেন, নাম মিলে যাওয়ায় তিনি নূর ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছেন। ঘরে তো বিদ্যুৎ নেই এবং পরোয়ানায় উল্লিখিত আসামির গ্রামও এক না—এমন প্রশ্নের জবাবে এএসআই বলেন, ‘এটা তো কয়েক দিন আগের কথা, এখন মনে পড়ছে না। ’ থানার ওসি বদরুল আলম খান দাবি করেন, ভুলটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির, পুলিশের নয়।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩-এর আওতাধীন ঈশ্বরগঞ্জের উপ-আঞ্চলিক কার্যালয়ে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. গোলজার হোসেন জানান, বিলখেলাপি মামলায় নূরুল আমীনের বদলে নূর ইসলাম লেখার কারণে সমিতির এনফোর্সমেন্ট কো-অর্ডিনেটার (ইসি) মো. ইদ্রিস আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং নূর ইসলামকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মগটুলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সালেহ মোহাম্মদ বদরুজ্জামান মামুন।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/04/01/481367