সাভার ট্যানারিতে সিইটিপি সংলগ্ন খোলা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বর্জ্য ;নয়া দিগন্ত
১৬ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৪

ধলেশ্বরীও খাচ্ছে ট্যানারি বর্জ্য: সাভারে গড়ে উঠছে আরেক হাজারীবাগ ; পানিতে মিশছে রাসায়নিক বর্জ্য

 

হাজারীবাগের ট্যানারির সর্বনাশা দূষণ থেকে রাজধানীর প্রাণ বুড়িগঙ্গাকে রক্ষার জন্য আদালতের নির্দেশে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ শুরু হয় দেড় দশক আগে। দীর্ঘ সময় পরও বুড়িগঙ্গাকে তো বাঁচানো সম্ভবই হয়ইনি, উল্টো অপরিকল্পিত কর্মযজ্ঞে শান্ত-সুন্দর ধলেশ্বরী নদীকেও গিলে খেতে বসেছে ট্যানারি বর্জ্য। এরই মধ্যে চামড়া শিল্পনগরীর কেমিক্যাল ও রাসায়নিক মিশ্রিত পানি ধলেশ্বরীতে মিশে নদীর পানি সম্পূর্ণ কালো করে ফেলেছে। মারা গেছে নদীর মাছ ও অন্যান্য প্রাণী। এলাকার শত শত মৎস্যজীবীর পেটে লাথি মারার পাশাপাশি ধ্বংস করছে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ। এ নিয়ে এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং থানা-পুলিশের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতায় হেমায়েতপুরে তৈরি হচ্ছে আরেক হাজারীবাগ। অথচ সব দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে ভুক্তভোগী কারখানা মালিকদের ওপর।
হেমায়েতপুরের অদূরে চামড়া শিল্পনগরী ঘুরে দেখা যায়, ট্যানারি পল্লীর উত্তর ও দণি পাশের সীমানাঘেঁষে ফেলা হচ্ছে ট্যানারি বর্জ্য। ট্যানারি পল্লীর একেবারে দণি প্রান্তে ট্যানারি পল্লীর জন্য ডাম্পিং স্টেশন তৈরির জায়গা রাখা হয়েছে। কিন্তু সেটি এখন পাঁচ বিঘা জমির ওপর অনেকটা পুকুরের মতো। এখন এই পুকুর ভরে গেছে ট্যানরির বর্জ্য।ে এখানে ফেলা সলিড বর্জ্য এবং ঝিল্লির অংশ ফেলায় সেগুলো গড়িয়ে পড়ছে পানিতে। আবার ট্যানারি পল্লীর উত্তরপাশে কিছুটা দূরে একেবারে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ঘেঁষেও ফেলা হচ্ছে ট্যানারির কঠিন বর্জ্য। ট্যানারির বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রিত এসব বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীর পানিতে। ফলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। আবার এখান থেকে বর্জ্যরে টুকরা কুকুর ও কাকে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
সাভারের ট্যানারি পল্লীতে যে কয়েকটি ট্যানারিতে লবণ মিশ্রিত কাঁচা চামড়া আনা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এপেক্স ট্যানারি, নবারণ ট্যানারি, মদিনা লেদার, রিলায়েন্স ট্যানারি ও মারসন্স ট্যানারি। এপেক্স ট্যানারির কারখানার ভেতরে ঘুরে দেখা যায়, এখানে দু’টি ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছে কাঁচা চামড়া। সেগুলো ট্রাক থেকে নামিয়ে ড্রামে তোলা হচ্ছে। ড্রামে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শেষে কঠিন ও তরল বর্জ্য আলাদা করা হচ্ছে। ডাম্পিং স্টেশন না হওয়ায় এ কারখানারও কঠিন বর্জ্য ও ঝিল্লি ফেলা হচ্ছে ওই খোলা জায়গায়। আর তরল বর্জ্য বা ক্রোম পানি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার হয়ে ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। ট্যানারি পল্লীর সিইটিপির পশ্চিম পাশের দেয়ালঘেঁষে রয়েছে ধলেশ্বরী নদীর পাড়। ভাঙনের হাত থেকে রার জন্য নদীর পাড়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাঁধের ভেতর দিয়ে মোটা পাইপ দিয়ে ট্যানারির পানি ফেলা হচ্ছে নদীতে। এ কারণে ধলেশ্বরী নদীর মাছ মরে ভেসে উঠেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যেসব সমস্যার কারণে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরানো হচ্ছে ঠিক একই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সাভারের ট্যানারি পল্লীতে। হাজারীবাগ থেকে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয়েছে ট্যানারির বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য। সাভার ট্যানারি পল্লীর বিষাক্ত পানি ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। হাজারীবাগে যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয় চামড়া ও চামড়ার ছাট বা কঠিন বর্জ্য। একইভাবে ট্যানারি পল্লীতে প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ওপর পুকুর সদৃশ্য উন্মুক্ত জায়গায় ফেলা হচ্ছে চামড়ার ছাঁট বা কঠিন বর্জ্য এবং তরল বর্জ্য। হাজারীবাগের আশপাশ দিয়ে গেলে নাক চেপে ধরে দৌড়ে পালাতে হয়, সাভারেও একই অবস্থা। চামড়ার গন্ধে ঝাওচর ও হরিণধরা গ্রামের মানুষ এখন অতিষ্ঠ। আর এভাবেই আরেক হাজারীবাগ হতে যাচ্ছে সাভার ট্যানারি পল্লীর এলাকা।
তাদের মতে, হাজারীবাগের ট্যানারি পল্লী পাকিস্তানি আমলে গড়ে উঠেছিল অপরিকল্পিতভাবে। সে কারণে হয়তো এখানে নিয়ম মেনে সব কিছু হয়নি। কিন্তু সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯.৪০ একর জমিতে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা ট্যানারি পল্লীতেও নদী ও পরিবেশ দূষণ ঘটছে। হাজারীবাগের দূষণের দায় ছিল ট্যানারি মালিকদের। আর সাভার ট্যানারি পল্লী ও আশপাশের এলাকা দূষণের দায় সরকারের। কারণ এখানে সরকারি কাজের ঘাটতিতেই ঘটছে দূষণ। ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরির দায়িত্ব সরকারের। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারে তরল বর্জ্য শোধনের পর পরিশুদ্ধ পানি ধলেশ্বরীতে ফেলার কথা। কিন্তু পানি শোধনের অংশের কাজ এখনো শেষ না হওয়ায় পরিশুদ্ধ পানির বদলে ধলেশ্বরীতে ফেলা হচ্ছে সোডিয়াম, ক্রোমসহ বিভিন্ন কেমিক্যলি মিশ্রিত পানি। এ কারণে এরই মধ্যে প্রায় মাছ শূন্য হয়ে পড়েছে নদীটি। তাছাড়া নদীর স্বচ্ছ পানিও এখন কালো রঙ ধারণ করেছে।
সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর কাজ বিসিক ‘খুবই গদাই লস্করীভাবে করছে’ মন্তব্য করে এর আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, প্রকল্প সম্পর্কে বিসিক সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে। এতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কারখানার মালিক-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের। কারণ ট্যানারি স্থানান্তরে সাভারের চামড়া শিল্পনগরী কতটা প্রস্তুত- তা বিসিক পরিষ্কার করছে না। তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানা স্থানান্তরের জন্য সাভারের চামড়া শিল্পনগরী মোটেও প্রস্তুত নয় জানিয়ে সংস্থাটির সহসভাপতি কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, অথচ এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে বিসিক। একই সাথে ট্যানারি সরাতে সরকারকে অযৌক্তিক ও অবাস্তব পদপে নিতে বাধ্য করছে সংস্থাটি। ফলে দেশের অত্যন্ত মূল্যবান একটি শিল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।
২০০১ সালে দেয়া আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানাগুলো সাভারের হরিণধরায় সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে তিন বছর মেয়াদি যে প্রকল্প হাতে নেয়া হয় তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এক যুগ আগে। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাতবার। ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে বাড়াতে করা হয়েছে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। কিন্তু অনেক সময় পার হলেও প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো হতাশাজনক বলে জানান উপকারভোগীরা। গত মাস পর্যন্ত চামড়া শিল্প নগরীর কাজে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৫৪ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে মাত্র ৫৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় এখনো ৪৯৪ কোটি ৯৩ লাখ খরচ করা হয়নি বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তবে বেশ কিছু বিল অপরিশোধিত থাকায় প্রকৃত কাজের চেয়ে আর্থিক অগ্রগতি কম দেখা যাচ্ছে বলে জানান প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।

www.dailynayadiganta.com/detail/news/203901