৫ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ১২:৩০

যারা হাইকোর্টের রায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ধর্মঘট করলো তাদের শাস্তি হবে কবে?

সারা বাংলাদেশে পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল সেটির মাস্টার মাইন্ড কে? কারা ছিলেন এর নেপথ্যে? প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকা রিপোর্ট করেছেন যে, পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি হলেন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান। আগে তিনি জাসদ করতেন, পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ২০০৯ সাল থেকেই মন্ত্রী আছেন। মন্ত্রী থাকলেও তার পাশাপাশি তিনি পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের প্রেসিডেন্টও রয়েছেন। এখন পত্র-পত্রিকায় বলা হয়েছে যে ধর্মঘটের আগে পরিবহন শ্রমিক নেতারা তাদের প্রেসিডেন্ট নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানের সরকারি বাসবভনে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেই পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তার পর দুই দিন ধরে সারা দেশে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে রাস্তা ঘাটে কি তাণ্ডব ঘটে গেল সেটি সকলেই জানেন। একজন পরিবহন শ্রমিক পুলিশের গুলীতে প্রাণও হারালেন। এসব ঘটনা কার ইঙ্গিতে? কে বা কারা ছিলেন এই আকস্মিক ধর্মঘটের নেপথ্যে নায়ক?

দ্বিতীয় দিনে জনদুর্ভোগ যখন চরমে উঠেছিল তখন মন্ত্রী শাহজাহান খান শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেন। তিনি বলেছিলেন যে, ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়ে অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ছুরি মাথায় নিয়ে শ্রমিকেরা বাস চালাতে পারে না। তিনি আরও বলেন যে, শ্রমিকরা তো ধর্মঘট করেনি, তারা কর্মবিরতি করেছে। তারা কাজ থেকে অবসর নিয়েছে। কেউ যদি তার কাজ থেকে ছুটি নেয়, তাহলে তাকে দিয়ে কি আর কাজ করানো সম্ভব? শ্রমিকরা অবসর নিয়েছে। অবসর তারা নিতেই পারে। জোর করে কি তাদেরকে কাজে নামানো সম্ভব?

শাহজাহান খান যখন এসব কথা বলেন, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই ধর্মঘট সম্পূর্ণ বেআইনি। অবিলম্বে এই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা উচিত। আরও অনেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা এই ধর্মঘটের কঠোর সমালোচনা করেন, তারা অবিলম্বে এই ধর্মঘট প্রত্যাহারের দাবি জানান। আর কি আশ্চর্য, কয়েকজন মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা যখন অবিলম্বে ধর্মঘট প্রত্যাহারের দাবি জানান তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রী শাজাহান খানের সরকারি বাসবভনে শ্রমিক নেতাদের আবার বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে তাদের প্রেসিডেন্ট শাজাহান খান শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে অবিলম্বে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আবেদন জানান। এবং সাথে সাথেই ধর্মঘট উঠিয়ে নেয়া হয়।

এখান সাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করে পালিত এই দুই দিবসের হরতাল ডাকল কারা? গত শনিবার পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান এই ধর্মঘটের জন্য দায়ী নন। তিনি আরও বলেন যে, নৌমন্ত্রী ছাড়াও তিনি সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি। কাজেই সভাপতি হিসাবে তার বাসায় সংগঠনের সভা হতেই পারে। তার অর্থ এই নয় যে তিনি ধর্মঘট করিয়েছেন। বরং তার আদেশেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই ধর্মঘটের ডাক দিল কে? নিশ্চয়ই ভূত-প্রেত এসে এই ধর্মঘটের ডাক দেয়নি, আর নিশ্চয়ই ভূত-প্রেতের কথায় এই ধর্মঘট পালিত হয়নি। মনুষ্য জাতির কেউ না কেউ এই অবৈধ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। ধর্মঘট করে তারা দুই দিন সারা দেশে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে। তাদের তাণ্ডবের ফলেই একটি মূল্যবান প্রাণ ঝরে গেছে। তাহলে শাজাহান খান ধর্মঘট ডাকেননি, একথা বললেই কি সরকারের সব দায় দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? কারা এই তাণ্ডব করল, সেটি কি খুঁজে বের করতে হবে না? একটি মূল্যবান প্রাণ ঝরে যাওয়ার জন্য কে বা কারা দায়ী তাদের কি সনাক্ত করতে হবে না?

‘প্রথম আলোর’ খবরে জানা গেল যে, সারা দেশে হঠাৎ আহূত ধর্মঘট (শাজাহান খানের কথায় কর্মবিরতি বা অবসরে যাওয়া) যাওয়া উপলক্ষে গাবতলী বাস টার্মিনালে যে তাণ্ডব হয়েছে, সরকারি সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে, সেই মামলার আসামী হয়েছেন কয়েকজন ট্রাক শ্রমিক। কিন্তু মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের যে নেতারা এই ধর্মঘট ডেকে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলেন, তাঁদের কেউই আসামী হলেন না। এর আগে যে কোন ধর্মঘটে, অঘটনে শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের নেতাদের নামেই মামলা হতো। ধরপাকড় চলত। কিন্তু এবার না হওয়ার কারণ কি? ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে। মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ হত্যা মামলায় আসামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। কিন্তু সাভারে যে নারী হত্যার দায়ে অপর এক আসামীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সেটিকে দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই। মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, আসামী পরিকল্পিতভাবে তার ওপর ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করেছেন। তার সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল। দুই ক্ষেত্রেই আসামীপক্ষ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করলে তারা উচ্চতর আদালতে যেতে পারত। কিন্তু তারা আইনের পথে না গিয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিয়েছে এবং তা ঘটেছে সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণকারী একাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তির মদদে।

স্বাভাবিক নিয়ম এই যে যিনি যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নন, তিনি সেই মন্ত্রণালয় নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের দায়িত্ব বন্দর ও নৌপরিবহন ঠিক রাখা। কিন্তু তাঁকে তাঁর মন্ত্রণালয় নিয়ে বেশি কথা বলতে দেখা যায় না। তিনি ব্যস্ত থাকেন সড়ক মন্ত্রণালয় ও পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে। এর আগে তিনি বলেছিলেন যে যারা গরু ছাগল চেনেন তাদেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া উচিত। সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে এ ব্যাপারে অসহায়ই মনে হলো। সড়ক মন্ত্রী একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক। স্বাভাবিকভাবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পর মন্ত্রিসভার অন্য যে কোন সদস্যের চেয়ে ক্ষমতাধর ভাবা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটল। সড়কমন্ত্রী পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান অযৌক্তিক বললেও নিজে সেই ধর্মঘট ভাঙার কোন উদ্যোগ নেননি। এমনকি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও ধর্মঘটিদের আইনের পথে আনার চেষ্টা না করে তাদের আইনি সহায়তা দেওয়ার কথা বললেন। কারণ, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যিনি কার্যকরী সভাপতি, তিনি আবার সরকারের একজন মন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যিনি সভাপতি, সেই মসিউর রহমান রাঙ্গাও একজন প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা।

এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন আসে। সরকারের কোন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী কি কোন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্বে থাকতে পারেন, যেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে? আইনত পারেন না। এমনকি সংসদ সদস্য এমন কোনো সংসদীয় কমিটিতে থাকতে পারেন না, যার সঙ্গে তাঁর পেশাগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, সরকার সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য একটি আইন করল। কিন্তু সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠন ফেডারেশন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। সে ক্ষেত্রে শাজাহান খানের ভূমিকা কী হবে? তিনি নৌ পরিবহন মন্ত্রী হিসেবে সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবেন? না কি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে তার বিরোধিতা করবেন? আবার সরকার পরিবহনের ওপর কোন কর ধার্য করল, যা পরিবহন মালিক সমিতির পছন্দ নয়। তখন প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমানই বা কোন পক্ষ নেবেন?

বিগত সরকার বিরোধী আন্দোলনে বাসে- ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় বিরোধী দলের জড়িত বা সন্দেহভাজন কর্মীদের পাশাপাশি নেতাদেরও হুকুমের আসামী করেছে সরকার। সেই মামলায় এখনো তাঁরা দৌড়ের ওপর আছেন। কেউ জামিনে, কেউ বা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু ৩৯ ঘণ্টা ধরে সারা দেশে যে মহা দুর্যোগ ঘটানো হলো, তার হুকুমের আসামী কে বা কারা ছিলেন, দয়া করে বলবেন কি?

যারা এই হরতালের ডাক দিয়েছিল, হরতালের পর নারকীয় তাণ্ডব করেছে, তারা শুধু জনগণের দুর্ভোগই সৃষ্টি করেনি। তারা আইনের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। উচ্চ আদালত অর্থাৎ হাইকোর্টের সেই রায়কে যদি রাজপথের আন্দোলন দিয়ে বাঞ্চাল করার অপচেষ্টা করা হয় তাহলে তো বলতে হবে যে আরেকটি গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। মৃত্যুদণ্ড তাড়াহুড়ো করে দেয়া হয়নি। ৪ বছর ধরে নিম্ন আদালতে বিচার হয়েছে, শুনানি হয়েছে, তার আগে যথারীতি তদন্ত রিপোর্ট হয়েছে এবং তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে অভিযোগ পত্র বা চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। তারপর ৪ বছর ধরে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

হাইকোর্টের এই রায়ে ওই ড্রাইভার বা পরিবহন সংগঠন যদি সংক্ষুব্ধ বোধ করেন তাহলে ন্যায় বিচার পাওয়ার আরও রাস্তা খোলা রয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তারা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যেতে পারতেন। সেখানে তাদের আর্জি পেশ করতে পারতেন। সেখানেও যদি এই দ- বহাল থাকে তাহলে তারা রিভিউ পিটিশন করতে পারেন। তাদের রিভিউ পিটিশন যদি খারিজ হয়ে যায়, তাহলে তারা প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে হাইকোর্ট যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সেটিই শেষ কথা নয়। অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ের পরেও তিনটি ধাপ বাকি আছে।

এসব ধাপ অতিক্রম না করে সরাসরি তারা যে অ্যাকশনে গেলেন সেটার চূড়ান্ত পরিণতি কার বিরুদ্ধে গেল? তাদের এই পদক্ষেপ অর্থাৎ ধর্মঘট, তাণ্ডব এবং উচ্ছৃঙ্খলতা আসলে গেল মহামান্য হাইকোর্টের বিরুদ্ধে। এব্যাপারে এখন সরকার কি করবেন? অন্যদের ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসলেই আদালত অবমাননার দায়ে তাদেরকে উচ্চ আদালতে তলব করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফর উল্লাহ চৌধুরী, ডেইলি নিউ এজের বিশেষ সংবাদদাতা ডেভিড বার্গম্যানসহ অনেক বিশিষ্ট নাগরিককে আদালতে তলব করা হয়েছে এবং আদালত অবমাননার অভিযোগে তাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তারপর নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে অভিযোগ থেকে মুক্তি নিতে হয়েছে। আর ধর্মঘটের নামে যারা হাইকোর্টের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ নিক্ষেপ করলো তারা কি এত সহজেই পার পেয়ে যাবে? আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে Pick & Choose পলিসি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে খারাপ নজির সৃষ্টি করবে।

http://www.dailysangram.com/post/274299