১০ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:০৫

মাধ্যমিক শিক্ষা খাত বিনিয়োগ কর্মসূচি

কেনাকাটায় দুর্নীতি অনিয়ম

টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ * কর্মশালা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের নামে চলে অর্থ অপচয়ের মহড়া

মাধ্যমিক শিক্ষা খাত বিনিয়োগ কর্মসূচির (সেসিপ) প্রকল্পের অধীনে ঢাকা ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সাড়ে ১২ কোটি টাকার আসবাবপত্র কেনার টেন্ডার দেয়া হয় কিছুদিন আগে। ইজিপিতে (অনলাইন টেন্ডার প্রক্রিয়া) ডাকা দুই প্যাকেজের এ টেন্ডারের ৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকার প্যাকেজে সর্বনিন্ম দরদাতা হয় মমতা এন্টারপ্রাইজ। দ্বিতীয় শফিক এন্টারপ্রাইজ এবং তৃতীয় রয়েল এন্টারপ্রাইজ। কিন্তু কাজ দেয়া হয়েছে তৃতীয়টিকে। টেন্ডারে মমতা এন্টারপ্রাইজ দর দিয়েছে ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা আর রয়েল এন্টারপ্রাইজ দিয়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে অন্তত ১৮ লাখ টাকা।

শুধু এই টেন্ডারই নয়, সেসিপ প্রকল্পের অধীন বিভিন্ন পূর্ত কাজ ও এর টেন্ডার প্রক্রিয়া, কম্পিউটার ও সায়েন্টিফিক সামগ্রী, গাড়ি ও বিভিন্ন স্টেশনারি কেনাকাটা, প্রশিক্ষণ-কর্মশালা ইত্যাদি সম্পন্ন হচ্ছে। এর প্রায় সব ক’টিতেই অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ আছে। আরও অভিযোগ, প্রকল্পের অধীনে আয়োজিত কর্মশালা-সেমিনার আর প্রশিক্ষণে চলে অর্থ অপচয়ের মহড়া। অংশগ্রহণকারীদের গণহারে ‘সম্মানী’ দেয়া হয়। ভূরিভোজ তো আছেই। বছরের শুরুতে অপ্রয়োজনে ব্যয়বহুল ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, কলম, কলমদানি, বিভিন্ন ধরনের শোপিস, ফুলদানি, টপ ইত্যাদি বিলি করা হয়। বিভিন্ন ব্যয়বহুল স্পটে আবাসিক কর্মশালা আয়োজনের ঘটনাও আছে। এভাবে অর্থ ব্যয়ের মহোৎসব চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

এ প্রকল্পের কেনাকাটার টেন্ডার প্রক্রিয়ার দায়িত্বে আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, টেন্ডার কাজ পেতে কারিগরি নানা শর্তপূরণ করতে হয়। পাশাপাশি সর্বনিন্ম দরদাতা হতে হয়। শুধু সর্বনিন্ম দরদাতা হওয়াই কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা নয়। কত টাকা লোকসান হল সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। মমতা এন্টারপ্রাইজের কাজের অভিজ্ঞতা এবং ব্যাংক গ্যারান্টি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তাই সর্বনিন্ম দরদাতা হলেও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেয়া হয়নি। তবে মমতা এন্টারপ্রাইজের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অভিজ্ঞতা এবং ব্যাংক গ্যারান্টি দুটিই সঠিক ছিল।

দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার বহুমুখী উন্নয়নে ‘সেসিপ’ নামে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এটিই সর্বোচ্চ বাজেটের প্রকল্প। তিন ধাপে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পে মোট ব্যয়ের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেবে এডিবি। বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগ ১৬.৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রথম ভাগে (২০১৩-২০১৭) এডিবির সহযোগিতার পরিমাণ ৯০ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশ সরকারের ১১৭.২৬ মিলিয়ন ডলার।

এ প্রকল্প থেকে গত বছরের অক্টোবরে বিভিন্ন স্কুলের জন্য ৮০ কোটি টাকার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি কেনাকাটার আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকা হয়েছিল। ওই টেন্ডারেও দ্বিতীয় সর্বনিন্ম দরদাতাকে কাজ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রকল্পে অর্থায়নকারী দাতাগোষ্ঠী পর্যন্ত আপত্তি দিয়েছিল।

এছাড়া স্কুলে সরবরাহের জন্য সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি কিনতে অপর আরেকটি টেন্ডার ডাকা হয়। স্থানীয় ‘অ্যাঞ্জেলিক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওই কাজ পেয়েছে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির দেয়া দর প্রাক্কলনের চেয়ে ৬৫ শতাংশ কম। অর্থাৎ সরকার যে জিনিস একশ’ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দরদাতা প্রতিষ্ঠান সেটি ৩৫ টাকায় দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি কেনাকাটায় যেখানে সচরাচর প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দর হাঁকার ঘটনা নিয়মিত, সেখানে এত কম দর দিয়ে দরদাতা প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে পোষাবে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত মালামাল সরবরাহ করেনি। তাই এ ক্ষেত্রে প্রাক্কলনে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দর নির্ধারণ করা হয়েছে, না নিন্মমানের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে দরদাতা প্রতিষ্ঠান ক্ষতি পোষাবে- তা এখনই মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, ওই টেন্ডারের পর এ বছরের শুরুর দিকে সেসিপের অধীন ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বৈজ্ঞানিক সামগ্রী সরবরাহের জন্য আরেকটি টেন্ডার ডাকা হয়। ২০০ কোটি টাকার এই কেনাকাটা ৫টি লটে হচ্ছে। তামিম ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশি এক প্রতিষ্ঠান কাজটি নিয়েছে। এক্ষেত্রেও প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় ৬৭ শতাংশ কম দর হাঁকা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুটি টেন্ডারেই সঠিক মানের মালামাল সরবরাহ করা হয় কিনা তা দেখার অপেক্ষায় আছেন তারা।

এ প্রকল্পের পরিচালকের (পিডি) দায়িত্বে আছেন মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের কেনাকাটায় একটি কমিটি আছে। তারাই সরকারি ক্রয় আইন (পিপিআর) অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। আইনের বাইরে গিয়ে কাউকে কাজ দেয়ার সুযোগ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান প্রাক্কলনের চেয়ে কত কম দরে কাজ নিয়েছে, সেটা মুখ্য বিবেচ্য নয়। টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মালামাল দিচ্ছে কিনা, সেদিকে আমরা নজর রাখব। প্রয়োজনে মালামাল গ্রহণকালে বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকবে। তাদের মতামত ছাড়া কোনো মাল নেয়া হবে না।

শুধু টেন্ডারই নয়, সেসিপসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় মাউশিতে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ঘিরে চলে ভোজবাজি। প্রশিক্ষণার্থী যত অংশ নেয়, তার দুই-তিনগুণ খাবার এনে শিক্ষা ভবনের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এর চেয়ে লুটপাট বেশি ঘটে বিভিন্ন প্রকল্পের সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে। এতে অংশ নেয়া মন্ত্রণালয়-মাউশিসহ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানীর নামে টাকা বিলানো হয়। প্রোগ্রামের দু’তিন দিন পরও ওই সম্মানীর খাম সংশ্লিষ্টদের নিতে দেখা গেছে।

এদিকে উপজেলা সদরে ৩১৫ মডেল স্কুল স্থাপন প্রকল্পের কার্যক্রম শেষের পথে। প্রকল্প চলাকালে এর পরিচালককে ব্যবহারের জন্য যে কক্ষ দেয়া হয়েছে, তিনি এখনও মাউশিতে সেটি দখল করে রেখেছেন। অভিযোগ আছে, এই পিডি মাউশিতে অন্য প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন। বিশেষ করে তার প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের সরবরাহের কাজ করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সুপারিশ করেন। তিনি মাউশির দ্বিতীয় ব্লকের একটি কক্ষ দখল করে রেখেছেন, যেখানে মাউশির একাধিক পরিচালক, বিভিন্ন প্রকল্পের পিডিসহ অন্যদের নিয়ে আড্ডাবাজির অভিযোগও রয়েছে। এই অভিযোগ মন্ত্রীর কানে পর্যন্ত গেছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রকল্পের (৩১৫ মডেল স্কুল) অধীনে কিছুদিন আগে একাধিক দফায় প্রায় ৩৮ কোটি টাকার ফার্নিচার কেনা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছিল সেগুলোর বেশির ভাগের অভিজ্ঞতার কাগজপত্র ছিল না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার কেউ কেউ ভুয়া অভিজ্ঞতাপত্র দাখিল করে। তা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে এসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। নানা অনিয়মের অভিযোগে এ প্রকল্পের কাজ এর আগে এক দফায় প্রায় এক বছর বন্ধ রাখা হয়েছিল।

জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট পিডি কেএম রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টেন্ডারের জন্য সুপারিশের অভিযোগ একদম অসত্য। যে কক্ষে আড্ডা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে প্রকল্পের মিটিং হয়, আড্ডা নয়। ওই কক্ষ মাউশি থেকে আমাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, অন্য কাউকে নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শর্তপূরণ করার পরই নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানকে ফার্নিচার সরবরাহের কাজ দেয়া হয়েছে। আর যে কোনো কাজ যেহেতু একটি কমিটির মাধ্যমে দেয়া হয়ে থাকে, তাই এক্ষেত্রে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। শর্তপূরণ না করা কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া সম্ভবই নয়।