২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ১২:২০

অথচ জামায়াত-শিবিরসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের দায়ী করেছিলেন সরকারের শীর্ষ স্থানীয়রা

সরদার আবদুর রহমান: গাইবান্ধার সরকারদলীয় এমপি লিটন হত্যার রহস্য শেষ পর্যন্ত উদঘাটন করেছে পুলিশ। এতে মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক এমপি এই হত্যার নায়ক বলে জানা গেছে। কিন্তু হত্যার পরপরই এই হত্যার জন্য জামায়াত-শিবিরসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের একসুরে দায়ী করেছিলেন সরকারের শীর্ষ দায়িত্বশীলরা। আর ঘটনার পর পর বিরোধীদলের বহু সংখ্যক নেতাকর্মী-সমর্থককে আটক করে কারানির্যাতনের মুখে ঠেলে দেয়া হয় বলে অভিযোগ উঠে।

উদঘাটিত তথ্যে জানা যায়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের এমপি আওয়ামী লীগ নেতা মনজুরুল ইসলাম লিটনকে পরিকল্পনা করে অর্থ দিয়ে খুন করিয়েছেন একই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. কাদের খান। তিনি এক বছর ধরে পরিকল্পনা করে এবং কিলারদের ছয় মাস ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ খুন করিয়েছেন। গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জে নিজ বাড়িতে গুলিতে আহত হন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে এর দেড় ঘণ্টা পরে তিনি মারা যান। ঘটনার পরপরই হত্যার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে বক্তব্য দেন আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক।

ঘটনার চারদিন পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিটন হত্যাকা-ের জন্য সরাসরি জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে বক্তব্য প্রদান করেন। গণভবনে ১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভায় শেখ হাসিনা বলেন, “সে (লিটন) জামায়াতের বিরুদ্ধে সবসময় ছিল। এমনকি গোলাম আযম ওখানে মিটিং করতে চেয়েছিল, সেই মিটিংও (লিটন) করতে দেয়নি, বাধা দিয়েছিল। সেই থেকে জামায়াতের একটা ক্ষোভ ওর ওপর ছিল। ওকে বেশ কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আর অবশেষে তারা সেই হত্যাকা-টা ঘটাল।” শেখ হাসিনা জামায়াতের পাশাপাশি তাদের জোটসঙ্গী বিএনপিকেও ‘হত্যার রাজনীতির’ জন্য দায়ী করে বলেন, “মানুষ হত্যা করা বিএনপির চরিত্র।”

একইদিন আ’লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্পাদকম-লীর বৈঠক শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাপুরুষোচিত কাজ বলে মন্তব্য করেন। একইসঙ্গে তিনি লিটন হত্যাকারী ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তিকে চরম মূল্য দিতে হবে বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। একই সাংবাদিক সম্মেলনে দলের যুগ্ম সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জামায়াত এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। আর এ অপশক্তির পৃষ্ঠপোষক বিএনপি।’ ১ জানুয়ারি রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে নামাজে জানাযাপূর্ব এবং মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে বক্তব্যে আ’লীগের অপর যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন সবসময় সুন্দরগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সে কারণে তিনি সবসময় জামায়াত-শিবিরের থ্রেটের মুখে থাকতেন। তারাই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির আবারো দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে তা-ব চালাচ্ছে। এমপি লিটন হত্যাকা-ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে জামায়াত-শিবির এখনো তৎপর। তাদের রুখে দিতে হবে। একইদিন ওই মাঠে আ’লীগের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এ হত্যাকা-টি পরিকল্পিত। তাকে তারাই হত্যা করেছে যারা ’৭১-এ এদেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। ধর্মের নামে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে, তারা এ হত্যাকা- সংঘটিত করেছে। তিনি সুন্দরগঞ্জে এ অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। একই দিনে হরতাল চলাকালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সুন্দরগঞ্জের বঙ্গবন্ধু চত্বরে প্রতিবাদ সভায় বলেন, জামায়াত-শিবিরের লোকজনই এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। তারা বহুবার তাকে আক্রমণ করেছিল। তিনি এ ঘটনার জন্য পুলিশকে দায়ী করে বলেন, জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে এমপির জীবনের থ্রেট থাকলেও পুলিশ তাকে সেভাবে প্রটোকল দেয়নি। তিনি সুন্দরগঞ্জ থানার ওসিকে ‘জামায়াত-শিবিরের দোসর’ বলেও মন্তব্য করেন। ৩ জানুয়ারি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এক সমাবেশে পৌর আ’লীগের সভাপতি আহসানুল করিম চাঁদ বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের লোক পুলিশ হত্যা মামলায় জামিনে এসে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়িয়ে আবারো এমপি লিটনকে হত্যা করেছে। পুলিশ ২৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় টাকার বাণিজ্য করেছে। এমপি হত্যার ঘটনায় কোনো বাণিজ্য করতে দেয়া হবে না। পুলিশ ব্যর্থ হলে আমরা আওয়ামী লীগের লোকজন এমপির খুনি জামায়াত-শিবিরদের চিহ্নিত করবো।’ একই সমাবেশে উপজেলা ছাত্রলীগ আহ্বায়ক ছামিউল ইসলাম ছামু বলেন, ‘সংসদ সদস্য লিটনের হত্যাকা-ের তদন্ত করে যদি পুলিশ খুনি জামায়াত-শিবিরকে বের করতে না পারে, তাহলে আমাদের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। আমরা সেই খুনি জামায়াত-শিবিরদের বের করে দেবো।’

রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তাও জামায়াত-শিবিরের দিকে ইঙ্গিত করে কথাবার্তা বলেন। হত্যাকা-ের দিন ৩১ ডিসেম্বর আইজিপি বলেছিলেন, এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন বাসায় ফেরার পর টহল পুলিশকে বিদায় করে দেন। এরপর এ খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। এলাকাটি জামায়াত অধ্যুষিত। হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের অল্পসময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে। ওই দিন আইজিপি আরো বলেন, ‘এলাকার সাধারণ লোক ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, খুনের সাথে জামায়াত-শিবির জড়িত থাকতে পারে। সংসদ সদস্য লিটন জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২ জানুয়ারি নামাজে জানাজার আগে এমপি লিটনের বাড়ির উঠানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুখ বলেছিলেন, এমপি লিটন হত্যাকা-ের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের দিকে ইঙ্গিত করেই মামলা করেছে পরিবার। ওই বিষয় নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে শুধু বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সরকারি দলের নেতৃবৃন্দ, এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দেড় শতাধিক মানুষকে আটক করা হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। আছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও। এই ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একদিনেই জামায়াত-শিবিরের ১০ নেতাকর্মীকে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা ঘটে।

http://www.dailysangram.com/post/273087