২৭ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:১১

সাড়ে ৫ বছরে ৫২০০ ধর্ষণ

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রায়ই ধর্ষণের ঘটনার নানা পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে। তবে এই পরিসংখ্যানই চূড়ান্ত নয়। এর বাইরে বহু ঘটনা নজরে আসে না। ফলে আড়ালের ঘটনাগুলো আড়ালেই থেকে যায়। ধর্ষিতা এবং প্রতিপক্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থানের তারতম্যের কারণে এসব ঘটনা সামনে আসে না। এমনকি মামলা পর্যন্তও গড়ায় না। আবার মামলা হলেও নানা কারণে পার পেয়ে যায় ধর্ষকরা। দেখা গেছে, গণমাধ্যম সরব হলেই কেবল ঘটনাগুলো সামনে আসছে। তবে যতটুকু গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় সে চিত্রও ভয়াবহ। গত সাড়ে ৫ বছরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সারাদেশে ধর্ষণের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। তাদের দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সাড়ে ৫ বছরে দেশে ৫ হাজার ২৪৮টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) বলছে, গত ৬ মাসে ১৪১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে আর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৩ নারী। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে শুধুমাত্র শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৬ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮ শিশুকে আর ৩ জন শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে আরো ২৮ শিশু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিসংখ্যান গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ নির্ভর। এর বাইরের চিত্র আরো ভয়াবহ।

আসকের দেয়া তথ্যানুযায়ী, সাড়ে ৫ বছরে গড়ে দিনে প্রায় ৩টি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে ৩৭৩ নারী ও শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ৫৬ জন। সংস্থাটির দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ১১৪৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৯৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১৪ জন ধর্ষণের অপমাণ সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৩ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৯৮ জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৮৭ জন আর একই কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৪ জন। ২০১৪ সালে ৭০৭ জন ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৬৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১৩ নারী-শিশু ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৫ সালে ধর্ষিত হয়েছে ৮৪৬ জন, খুন করা হয়েছে ৬০ ধর্ষিতাকে এবং আরো ২ জন আত্মহত্যা করেছে। ২০১৬ সালে ৭২৪ নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৩৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং একই কারণে আত্মহত্যা করেছে ৮ জন।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সাড়ে ৫ বছরে ১৭১৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৮৬, ২০১৩ সালে ১৭০, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন শিশু ধর্ষিত হয়েছে। অতীতে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু এই নৃশংসতার শিকার হয়েছে। গত বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৬ জন শিশু। আর চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৬ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮ শিশুকে আর ৩ জন শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে আরো ২৮ শিশু।
তবে এই পরিসংখ্যান যত ভয়াবহ-ই হোক এটি বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার খণ্ডিত চিত্র মাত্র। সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহকারীরা বলছে, এ পরিসংখ্যান মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ নির্ভর। এছাড়া কেউ কেউ তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও তথ্য সংগ্রহ করেন। তবে একটি বড় অংশই থেকে যায় খবরের আড়ালে। এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একই ব্যক্তি একাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে। সামনে এসেছে মাত্র একটি। এরপর তদন্তে বা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে একাধিক ধর্ষণের ঘটনা। তবে পরিসংখ্যানে একটি ঘটনাই যোগ হয়েছে। আবার অনেক ঘটনা প্রকাশই পায় না। ফলে সেগুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ধর্ষণকারী সমাজের প্রভাবশালী হওয়ায় ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে আপস-মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে। অনেক ঘটনায় মামলা হচ্ছে না বা সংশ্লিষ্ট থানা মামলা নিচ্ছে না।

জানা যায়, গত ৯ই আগস্ট রংপুর পিবিআই নীলফামারীর ডিমলার উপজেলার বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে। ভিডিও এবং ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে সে একাধিকবার একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিলো। সেটা ভিডিও করে। একপর্যায়ে মেয়েটি আর রাজি না হলে নূর মোহাম্মদ ধর্ষণের অশ্লীল কিছু ছবি ভিকটিমের পরিচিত রুমমেটদের ফেসবুক এবং হোয়াটস্ অ্যাপ মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়। পরে ভিকটিমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর পিবিআই জানায়, প্রাথমিক তদন্তে তার বিরুদ্ধে একাধিক মেয়ের সঙ্গে একই ঘটনা ঘটানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। বনানীর রেইন্ট্রি হোটেলে ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধেও একাধিক অভিযোগ ওঠে। কিন্তু দুই ছাত্রীর অভিযোগের আগে সে ঘটনাগুলোও আড়ালেই থেকে গিয়েছিল। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রভাবশালী ধর্ষকদের একটা ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পরপরই তাদের একাধিক ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে আসে। বগুড়ায় ধর্ষণের শিকার ছাত্রীর মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনা তার একটি। আবার অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও মান-সম্মানের ভয়ে নিজে থেকেই সামনে আসছে না। ধর্ষিতার পরিবারও বিষয়টি চেপে যাচ্ছে। এভাবে প্রতিদিনই চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক ঘটনা।

এ ব্যাপারে বিএসএএফ-এর প্রোগ্রাম অফিসার আজমি আক্তার বলেন, তথ্যগুলো মূলত প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগ্রহ হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। বিশেষ করে নিকটাত্মীদের দ্বারা যখন এমন ঘটনার শিকার হয় তখন অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। এছাড়া অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়ে আইনি সহযোগিতাও পান না। ধর্ষকের কাছে ম্যানেজ হয় যান অনেক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্মীও। ফলে সে ক্ষেত্রেও ঘটনা আড়াল হয়ে যায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংগ্রহকারী কর্মকর্তা ঝর্ণা খানম বলেন, তারা ৯টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য সংগ্রহ করেন। এছাড়া স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও কিছু তথ্য পান। তবে তা খুবই সামান্য।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=80696