২৩ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ১:১৬

নদী ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে অসংখ্য পরিবার

মোস্তাফিজুর রহমান কুড়িগ্রাম থেকে : কুড়িগ্রাম জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার পানি কমছে। তবে বাড়ছে দুর্ভোগ। তীব্র হচ্ছে নদীভাঙ্গন। হারিয়ে যাচ্ছে সহায় স্বম্বল। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি জমি ও ফসল। কমে যাচ্ছে জেলার কৃষি উৎপাদন। গৃহহীন হচ্ছে নদী শিকস্তি পরিবার। বন্যায় জেলায় কৃষকের এবং যোগাযোগের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে ব্রীজ ও রাস্তাঘাট। জেলার ক্ষতিগ্র¯ত পরিবারগুলো এখনো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রবল বেগে ধেয়ে আসা তীব্র পানির ¯্রােতে রেল সেতু ধসে ও রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা। এরই মধ্যে জেলায় সাড়ে ৫ শতাধিক পরিবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সহায় সম্বল হারিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব অসহায়দের মাঝে খিচুরী ও ত্রাণদেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলুনায় সামান্য বলে জানিয়েছে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অনেকে। এ রিপোর্ট লেখা পয্যন্ত জেলায় এখনো হাজার হাজার পরিবারের ঘরবাড়ী প্রায় ২ ফিট পানির নীচে তলিয়ে রয়েছে দুর্গম চর ও নীচু এলাকায়।

নদী ভাঙ্গনের শিকার এবং বন্যার্তদের মাঝে জ্বালানি, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মানব খাদ্যের পাশাপাশি গো-খাদ্যেরও চরম সংকট চলছে। বেড়ে গেছে গো-খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম। ফলে নদী ভাঙ্গন ও বন্যাদুর্গতরাসহ সর্বস্থরের ক্রেতাগণ দারুন বেকায়দায় পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি আর খাদ্য সংকটের উপর আশ্রয় রয়েছে সংকট। দেখা দিয়েছে হাতে পায়ে ঘাঁসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ। রাস্তা ঘাটের বেহাল দশা।

সরেজমিনে খোজ নিয়ে জানাগেছে কুড়িগ্রামের সাথে রেল যোগাযোগ বন্ধরয়েছে ১০দিন ধরে। জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৬টি নদ-নদীর পানি হ্রাস পেলেও বন্যাদুর্গতদের দুর্দশা কমেনি, বেড়েছে নদী ভাঙ্গন। কমেনি চাল, ডাল, লবন, তেল ও গো-খাদ্যসহ নিত্যপন্যের দাম।
এখনও হাজার হাজার পরিাবার বাধের রাস্তার দু’ধারে বড় রাস্তার পাশে উঁচু স্থানে ও আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। আশ্রিত মানুষ আর গবাদি পশু এক সঙ্গে বাস করায় এবং যত্রতত্র মলত্যাগের কারণে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে এলাকার পরিবেশ। অনেক নদী শিকস্তি ও বানভাসী পরিবার খেয়ে না খেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
এদিকে জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে ত্রাণবিতরণ করায় সুষ্ঠু বিতরণের খবর পাওয়া গেলেও জেলার রৌমারী, রাজিবপুর এবং চিলমারী উপজেলায় বণ্যার্তদের মাঝে ত্রাণবিতরণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠছে। সেখানে সেনাবাহিনী না থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে ১ লাখ, ২৫ হাজার ১০৫ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য ৬৯ লাখ, ৫৫ হাজার টাকা এবং ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানাগেছে। এছাড়াও জেলায় বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা ত্রাণবিতরণ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

বাগমারা (রাজশাহী) সংবাদদাতা : চারি দিকে থই থই পানি । বিল পেরিয়ে লোকালয়। কিন্তু বাড়ি ঘরে নেই লোকজন। একটু এগিয়ে যেতে ত্রাণের নৌকা বুঝে স্কুল ও কলেজ পাড়ের লোকজন ছুটে আসল নৌকার দিকে। চোখে পরল স্কুল কলেজ ঘরের ভিতরে গাদাগাদা বিছানা আর কিছু আসবাবপত্র। অনেকে ছুটে আসছে ত্রাণের নৌকার দিকে। উপজেলা গার্লস গাইড এ্যসোসিয়েশন কিছু ত্রাণ দেবে। গৃহবধূ, বৃদ্ধ , বৃদ্ধা, যুবক, যুবতীসহ নানা বয়সের ছেলে-মেয়ে ত্রাণের আসায় সামনে এগিয়ে আসে। বৃদ্ধ কলিম উদ্দিন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ৫ দিন ধরে বাড়িত আন্নবার পারিনিহ অ্যামার বউ। মুড়ি টুড়ি খাইয়্যা আছি কোন মতো। বৃদ্ধা কুলসুম জানান, বাড় ঘর ডুইব্যা গ্যাছে থাকার জাগা না পাইয়্যা ইসকুলেত আলছি। ভাত খায়নি ৪/৫ দিন থ্যাইক্যা। এই চিত্র ছিল সোনাডাঙ্গা ইউনিয়নের সোনাডাঙ্গা গ্রামের। গত সোমবার সকাল থেকে এই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের দুর্দশার এমনই চিত্র। উপজেলার গোবিন্দপাড়া, নরদাশ ,আউচপাড়া বাসুপাড়া সহ বিভিন্ন ইউনিয়নে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাস, ইউনিয়ন পরিষদসহ উচু স্থানে গাদাগাদি করে থাকছে বানভাসী পরিবার পরিজনদের নিয়ে। বানভাসীদের অভিযোগ শুকনা খাবার খেয়ে কখনও না খেয়ে তাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মাসেদুর রহমান জানান, বানভাসীদের অবস্থা খুবই খারাপ । এ পর্যন্ত সরকারি ভাবে বানভাসী ২৬৩০৫ জনের তালিকা চেয়ারম্যানগণ হাতে পেয়েছেন। তবে এসংখ্যা আরো অনেক বাড়বে। সরকারি ভাবে বানভাসীদের সাহায্য দেয়া অব্যাহত রয়েছে। সোনাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজাহারুল ইসলাম জানান, ইউনিয়নের অধিকাংশ লোক বাড়ি ছাদে কলেজ, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। বাড়িতে থাকতে না পেরে তারা রান্না-বান্না করতে পারছেন না। সরকারি ভাবে কিছু কিছু স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অধিকাংশ এলাকায় ত্রাণ মেলেনি। উপজেলা গার্লস গাইড এ্যসোসিয়েশন বহরের কমিশনার চানপাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাজমা বেগম এ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান। নরদাশ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, তার ইউনিয়নে বানভাসীরা সরকারি অনুদান খুবই কম পেয়েছে। অধিকাংশ বানভাসীরা না খেয়ে দিন যাপন করছেন। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এলাকার বন্যা পরিস্থিতি তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে কোন কোন স্থানে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি কমেছে বলে দাবি করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকিউল ইসলাম। এছাড়া তিনি সরকারি ভাবে উপজেলায় ৫৫ টন খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) সংবাদদাতা : চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পুনর্ভবা ও মহানন্দা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানির তোড়ে গতকাল মঙ্গলবার আলিনগর ইউনিয়ন রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ফলে ওই ইউনিয়নের শত শত বিঘা জমির ফসল, বাড়ীঘর ও মৎস্য ক্ষেত্র চুড়ইল বিলের মাছ হুমকির মুখে পড়েছে। আলিনগর ইউপি চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম জানান, সোনাতলা বাঁধের বেশ কয়েকটি অংশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এরমধ্যে মঙ্গলবার সকালে ওই বাঁধের একটি অংশ ভেঙ্গে পানি প্রবেশ করে। এছাড়া অপর একটি অংশ বেশী ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। সেটিকে কোন রকমে রক্ষার চেষ্টা চলছে। এছাড়া জনপদে বন্যার পানি প্রবেশ রোধে বিভিন্ন কালভাট ও সেতুর নিচে অস্থায়ী বাঁধ দেয়া হচ্ছে। এদিকে পুনর্ভবা নদীর পানি গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত মাত্র ৩ সেঃমিঃ পানি বাড়লেও দুপুরের পর থেকে পানি বৃদ্ধির হার স্থিতিশীল রয়েছে। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় রহনপুর রেল ব্রিজ পয়েন্টে পুনর্ভবা নদীর পানি বিপদ সীমার ৮০ সেঃমিঃ উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া পুনর্ভবা ও মহানন্দা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে উপজেলায় বন্যার্তদের মাঝে সরকারি ভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে। উদ্বোধনী দিনে স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইউএনও শিহাব রায়হান, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান আকবর।

http://www.dailysangram.com/post/297149