নিকট ও বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মিত্র শক্তির ভূমিকা পালন করেছে-এ বিষয়ে তেমন বিতর্ক নেই। তবে একথা যৌক্তিক নয় যে, ভারত সাহায্যে এগিয়ে না এলে আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না। কিন্তু একথা যৌক্তিক যে, ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা করার কারণে আমাদের বিজয়টা সহজতর হয়েছে। তাই আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ। সঙ্গত কারণেই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত-বাংলাদেশ অকৃত্রিম বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী হতে পারতো। কিন্তু দেশটির আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও প্রভুসুলভ মনোভাবের কারণে স্বাধীনতার পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও ভারতীয় শাসক চক্রের সাথে বাংলাদেশের মানুষের হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি।
বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক গড়ার পরিবর্তে এদেশে একটি আজ্ঞাবাহী ও দাসানুদাস শ্রেণি সৃষ্টি করেছে। যারা দেশ ও জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিগত দিনগুলোতে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা ও রীতিমত প্রভু তোষণে ব্যস্ত ছিল। এরাই বিগত প্রায় ১৬ বছর একটি অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে অপশাসন-দুঃশাসন চালাতে সহায়তা করেছে। যা বাংলাদেশের মানুষ কোন দিনই ভুলে যাবে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করার দাবিদার হলেও তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোটেই স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ছিল না বরং তাদের আজ্ঞাবাহী প্রতিবেশী সৃষ্টি করাই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য। তাই স্বাধীনতার পরও তারা আমাদের সার্বভৌমত্বকে মেনে নেয়নি। তারা তাদের আজ্ঞাবাহীদের কাছে অনেক সুবিধা আদায় করে নিলেও বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি বরং দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন সমস্যাকে এখন পর্যন্ত জিইয়ে রাখা হয়েছে। তারা ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সাথে ত্রিশসালা গঙ্গাচুক্তি পানিচুক্তি করলেও চুক্তির শর্ত মোতাবেক পানি প্রদান করেনি বরং ভারত তাদের মর্জিমত বর্ষাকালে আমাদেরকে ডুবিয়ে মেরেছে। আবার খরা মওসুমে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে দেশকে মরুকরণের মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাজ্য সরকারের কথিত আপত্তির ধুয়া তুলে তারা বাংলাদেশের সাথে এখনো তিস্তার পানি চুক্তি করেনি। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে এখন মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়াও ভারত বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক কোন সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক সমাধান করেনি বরং বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে দেশটির সাথে আমাদের যতগুলো চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে তার সবই ছিল ভারতের অনুকূলে; সম্পূর্ণ একপাক্ষিক। দেশটির সাথে আমাদের নৌ ও স্থল ট্রানজিট ছিল আমাদের সার্বভৌমত্ব বিরোধী অসম চুক্তি।
সর্বোপরি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সব সময় অগ্নিগর্ভই ছিল। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সব সময় আমাদের সাথে আগ্রাসী আচরণ করে এসেছে। বিএসএফের গুলীতে প্রতিনিয়তই প্রাণ হারিয়েছে বাংলাদেশী নাগরিকরা। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর নির্মমভাবে গুলী চালানো ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের রীতিমত ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছিল। আবার সব সময় দাবি করে এসেছে তারাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে এবং দেশটি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও ভারত সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। ফলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
মূলত, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম দেশ। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে চীনের পরই ভারতের স্থান। শুধুমাত্র চীন ছাড়া ভারতের সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্র সবদিক থেকেই পিছিয়ে। কিন্তু কোন প্রতিবেশীর সাথেই এই বৃহৎ কথিত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির সুসম্পর্ক নেই বরং ক্রমেই এই অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এ জন্য ভারতের প্রতিবেশীদের প্রতি কর্তৃত্ববাদী, অন্যায্য ও আধিপত্যবাদী মনোভাবকেই দায়ী করা হচ্ছে। ভারত কখনোই কোন প্রতিবেশীর সাথেই সদাচরণ করেনি বরং সব সময় বিগ ব্রাদারসুলভ আচরণ করে এসেছে। সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রণীত হয়নি ভারতের প্রতিবেশী ও পররাষ্ট্রনীতি। ফলে প্রতিবেশীদের সাথে দেশটির দূরত্ব বেড়েছে দিনের পর দিন। সঙ্গত কারণেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারত বিরোধিতা প্রবল হতে প্রবলতর হচ্ছে। কিন্তু বৃহৎ এই দেশটি সেদিকে খেয়াল না করে সকল প্রতিবেশী রাষ্টেই একটি আজ্ঞাবহ ও দাস শ্রেণি সৃষ্টি করার নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দেশটির মনস্তাত্তিক দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এমন অভিযোগই করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধামহল।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালদ্বীপের মত দেশগুলোতে ভারত বিরোধিতার জন্য ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এই দাবির কোন যৌক্তিকতা বা সারবত্তা আছে বলে মনে হয় না। এদেশে ভারত বিরোধিতা ধর্মীয় কারণে নয় বরং এসব দেশের মানুষ ভারতের অন্যায্য অবস্থান, কর্তৃত্ববাদী মনোভাব ও জনগণের আবেগ-অনুভূতির বিপরীতে গিয়ে শ্রেণি ও গোষ্ঠী তোষণকে কোন ভাবেই পছন্দ করছেন না। যদি তাদের দাবি সত্য হয়, তাহলে নেপালে ভারত বিরোধিতা এখন তুঙ্গে কেন? দেশটি তো বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। আরেক নিকট প্রতিবেশী ও সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলঙ্কাতে ভারত বিরোধিতা এখন ক্রমবর্ধমান। একেবারে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী ভূটানের সাথেও এই বৃহৎ প্রতিবেশীর সম্পর্ক খুবই একটা সুখকর নয়। চীন তো দেশটির প্রধান প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালদ্বীপে ভারত বিরোধিতা ধর্মতাত্ত্বিক ও কথিত ইসলামী মৌলবাদের উত্থান বিষয়ক হয়, তাহলে এসব অমুসলিম দেশে ভারত বিরোধিতা কেন গতি পেল তার কোন সদুত্তর নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে।
মূলত, ভারতের প্রতিবেশী ও পররাষ্ট্রনীতি দেশটির প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের আবেগ-অনুভূতির শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে প্রণীত হচ্ছে না বরং দেশটি গোষ্ঠী তোষণের মাধ্যমে সুবিধাভোগী শ্রেণি সৃষ্টি করে নিজেদের আধিপত্য বাজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। যা ইতোধ্যেই হিতে বিপরীতও হতে শুরু করেছে। প্রতিবেশী দেশ নেপালে ভারত বিরোধী বলয়ের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও একই অবস্থা। তারা ভারতের অন্যায্য আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় চীনের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু চীন সফর শেষ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশটি থেকে সকল ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। মূলত, এটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে ভারতের মত বৃহৎ রাষ্ট্রের জন্য রীতিমত চপেটাঘাত। আর তা হয়েছে ভারতের প্রতিবেশীদের সাথে অপ্রতিবেশীসূলভ আচরণের কারণেই।
মূলত, নানাবিধ কারণেই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব তলানিতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে ভারতের একই রকম সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ভারত এই সম্পর্ক নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জনগণকে বিবেচনায় রাখে না বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। চলতি বছরের শুরুতে ইউটিউব ভিত্তিক চ্যানেল ‘সার্চ অফ মিস্টেরি’তে ‘হোয়াই এন্টি-ইন্ডিয়া সেন্টিমেন্ট ইজ গ্রোয়িং ইন মালদ্বীপ, বাংলাদেশ অ্যান্ড নেপাল?’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশের শুরুতে এমন মন্তব্য করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দিল্লীর গভীর সম্পর্ক দেশটির জনগণের জন্য খুবই বিরক্তিকর। নিকট অতীতের কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এর প্রভাব আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের হারের পর ঢাকা শহরে যেভাবে বিজয় উদ্যাপন হয়েছে তা উদ্বেগের কারণ। এ ঘটনা নিয়ে দুই দেশেই আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন কারণে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের হয়রানি করার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই আলোচনায় অপ্রয়োজনীয় রঙ যোগ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। আর এর যৌক্তিক কারণও আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধামহল। তাই বিষয়টি নিয়ে বৃহৎ এই প্রতিবেশীর নতুন করে ভাবার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তারা এখনো ইতিবাচক নয়।
বাংলাদেশের দেশপ্রেমী জনগণের এই ভারত বিরোধিতা শাসকমহলের বিরুদ্ধে- কিন্তু ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে নানাবিধ কারণেই ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে। উভয় দেশের জনগণের মধ্যে রয়েছে ঊষ্ণ হৃদ্যতা। বস্তুত, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে তা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের বিশ্লেষকরাও মনে করেন, ভারত সরকারের কিছু কিছু নীতি এই মনোভাবকে প্রবল মাত্রায় ইন্ধন দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে। যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
অবশ্য আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু সেই প্রভাব যদি জনগণের সার্বভৌম অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে তাহলে জনগণের মধ্যে তার প্রভাব পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বরং এটিই যৌক্তিক। গত ৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এই নির্বাচনে স্বীকৃত কোন বিরোধী দল অংশগ্রহণ করেনি। এটি ছিল আরেকটি একদলীয় নির্বাচন যখন বিরোধী দল কারাগারে বন্দী ছিল। ভারত গত প্রায় ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নিজেদের নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা নিকট অতীতে বাংলাদেশের নাগরিকদের হাতে ছিল না। সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অঙ্গুলি হেলনে। এমন নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক বোদ্ধামহলে। যা সাধারণ মানুষকে ভারতের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলতে অনেকটা সহায়ক হয়েছে।
এই ধরনের ধারণা আরও জোরদার হয় যখন এক বাংলাদেশী সাবেক মন্ত্রীকে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায়, যেকোনো মূল্যে হাসিনা সরকারের টিকে থাকা নিশ্চিত করার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধ করেছেন এবং ভারত তার অনুরোধটি আমলে নিয়েছে। বাংলাদেশী বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন এবং বলছেন যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভারতের পক্ষে একতরফা হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারত তার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহ দমন, বাংলাদেশে ট্রানজিট সুবিধা, বঙ্গোপসাগরের দু’টি প্রধান বন্দরে স্থায়ী প্রবেশাধিকার, জ্বালানি চুক্তি, বঙ্গোপসাগরে নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করেছে। বিপরীতে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশের অনুরোধ কয়েক দশক ধরে বারবার উপেক্ষা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সবচেয়ে সহিংস সীমান্তে পরিণত হয়। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কয়েক বছর ধরে ভারতের পক্ষে বিস্তৃত হয়েছে। এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটেও ভারতের কাছ থেকে খুব একটা সহযোগিতা পায়নি বাংলাদেশ। এসব যৌক্তিক কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে ভারতের একতরফা সমর্থনে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং ভারত বিরোধিতা এখন বেশ তুঙ্গে উঠেছে। এমনকি তা ভারতীয় প্রভুত্ব ও আগ্রাসন মোকাবেলায় ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনর সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
মূলত, ভারত সরকারের ভ্রান্ত প্রতিবেশী নীতির কারণে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। অনেকের মতে ভারতের একতরফা সমর্থনে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার দীর্ঘ পরিসরে ক্ষমতায় ছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরেকটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রবেশ করেছে যখন দেশটি রাজনৈতিকভাবে অচলাবস্থার দিকে যাচ্ছে। যা কোনভাবেই কাম্য ছিল না।
কোন দেশে সাম্রাজ্যবাদ প্রবেশ করবে এবং কোন দেশে করবে না সেটি সম্পূর্ণভাবে একটি দেশের মৌলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে। সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, এই তিনটি ভিত্তিই এখন শূন্য। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগ সফলভাবেই ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলতেন বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রাজত্ব শেষ এবং সেটা ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছিল? আমরা কি এখন দেখতে পাচ্ছি না যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ফিরে এসেছে? বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতীয় আধিপত্যবাদ পরোক্ষভাবে বাংলাদেশে মার্কিন হস্তক্ষেপে এই প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করেছে বলেই মনে করছেন তত্ত্বাভিজ্ঞমহল। ভারত বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর দেশ এবং বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশটি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতির জন্য দুই দেশের রাজনীতিবিদরা যেমন দায়ী, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রোপাগান্ডাও সমানভাবে দায়ী।
মূলত, ভারত বাংলাদেশের জনগণের সাথে কোনভাবেই সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি বরং তারা এদেশে তাদের আজ্ঞাবাহী সেবাদাস শ্রেণি সৃষ্টি করে তাদের প্রভুত্ব বজায় রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। তারা ধরেই নিয়েছিল ভারত বৃহত্তর আঞ্চলিক শক্তি হওয়ায় দেশটির প্রভাব বলয়ের বাইরে বাংলাদেশে কোন সরকার টিকে থাকা সম্ভব নয়। এমনকি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারো পক্ষে ক্ষমতায় থাকা অলীক কল্পনা। কিন্তু তাদের সকল জল্পনা-কল্পনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এখানে ভারতের কোন ম্যাকানিজমই কাজে আসেনি বরং ভারত সমর্থিত বাকশালী ও স্বৈরাচারী শক্তি লজ্জাজনকভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে।
এরপরও ভারতের ষড়যন্ত্র বন্ধ থাকেনি। তারা পলাতক স্বৈরাচারিনীকে সেদেশে আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং এদেশে অস্থিরতা তৈরির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কল্পকাহিনী প্রচার করে দেশকে অস্থিতিশীল করে স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের অপচেষ্টা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়াগুলোও গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করেছে। পিছিয়ে ছিল না ভারতের ক্ষমতাসীনরাও। কিন্তু ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৪৮ সাল থেকে সত্য, মিথ্যা এবং গুজবের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জনমতের মধ্যে ভারত সম্পর্কে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। তাই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব সাবধানে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে মনে করেন অভিজ্ঞমহল। এক্ষেত্রে ভারতের একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের জনগণের স্পন্দন বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। ভারতের চারপাশের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু ভারত বাংলাদেশে প্রভুত্ব করার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার করার বাহানাকে পুঁজি বানিয়েছে। কিন্তু ঘটক যদি বিয়েতে সহযোগিতা করার জন্য অনৈতিক কিছু দাবি করে তাহলে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বাংলাদেশের মানুষ কোনভাবেই ভারত বিরোধী নয় বরং ভারতের শাসকগোষ্ঠীর ভুল নীতি ও দেশটিতে ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদের উত্থানই বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণকে ভারত বিদ্বেষী করতে সহায়ক হচ্ছে। তাই সময় এসেছে ভারতের প্রতিবেশী নীতি পুনর্মূল্যায়নের। বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারত সকল প্রতিবেশীর সাথে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করবে এবং সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে। এ প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয় ও আত্মসচেতন মানুষের। বাংলাদেশের জনগণ এই বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটির কাছে গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে।
