ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সীমানা নির্ধারণের আট বছর পরও ফেনীর পরশুরামে মুহুরীর চরে যেতে পারছে না বাংলাদেশীরা। বিরোধপূর্ণ ওই জমিতে দু’দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের যৌথ জরিপ দল সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তারা কাঠের পিলার স্থাপন করে দিলেও ভারতের পক্ষ থেকে স্থায়ী পিলার নির্মাণের সম্মতির অভাবে এ সমস্যা রয়েই গেছে।
এ দিকে ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় মুহুরীর চর এলাকার নিজ কালিকাপুরের বল্লারমুখ সীমান্ত এলাকায় বেড়িবাঁধ পুনঃনির্মাণ গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়েছে বাংলাদেশ। মুহুরীর চর বিরোধ ঝুলে থাকায় এ ব্যাপারেও ঠিকাদারদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিরোধপূর্ণ সীমান্ত সমস্যার সমাধান না হওয়ার সুযোগে চোরাকারবারি ও অবৈধ অনপ্রবেশকারীদের নিরাপদ পয়েন্ট হিসেবে ওই এলাকাটির ব্যবহার বাড়ছে। মুহুরীর চর এলাকায় বিলোনিয়া স্থলবন্দর হওয়ায় জঙ্গি তৎপরতা ও মাদকপাচারসহ বিভিন্ন সীমান্ত অপরাধের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে দুই দেশ। ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর বিরোধপূর্ণ মুহুরী চর সরেজমিন দেখতে এসে দুই দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্ঠা গওহর রিজভীসহ বিগত কয়েক বছরে সরকারের সচিবসহ ঊর্ধŸতন কর্মকর্তারা বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চর পরিদর্শন করেছেন একাধিকবার। কিন্তু ভারতের অসহযোগিতার অভাবে এখন পর্যন্ত কার্যত ফল হয়েছে শূন্য- এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা মুহুরীর চরের বিরোধ মীমাংসা ও সীমানা নির্ধারণে একাধিকবার দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়েও আলোচনা হয়েছিল।
২০১৭ সালের ১৫ জুলাই বিলোনিয়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক বাংলাদেশে এসে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, ফেনীর পরশুরাম সীমান্তে দীর্ঘ দিনের ঝুলে থাকা মুহুরীর চর সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারেও আশাবাদ শুনিয়েছিলেন।
জানা গেছে, ভাঙনের কবলে পড়ে বাংলাদেশের জমি মুহুরী নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশীরা তাদের জমিতে চাষাবাদ করা নিয়ে অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে দু’দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে। দুই প্রতিবেশী দেশের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল। তিস্তা নিয়ে আলোচনা ও সিটমহল বিনিময় চুক্তি করার পর থেকে মুহুরীর চরের জমি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আশায় বুক বেঁধেছিলেন বাংলাদেশীরা। কিন্তু দু’দেশের যৌথ জরিপ দলের নির্ধারণ করে দেয়া সীমানায় স্থায়ী পিলার স্থাপনে ভারতের অনীহার কারণেই মূলত ঝুলে রয়েছে মুহুরীর চর বিরোধ। সীমানা নির্ধারণ হলেও নিজেদের জমিতে এখনো যেতে পারছেন না বাংলাদেশীরা ।
সূত্রে জানা গেছে, মুহুরীর চর দখলে রাখতে ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৫৮ দিন ভারতীয় বিএসএফ ও বিজিবির (বিডিআর) মধ্যে গুলিবিনিময় হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশের বাউর পাথর গ্রামের বেয়াধন বিবি (৪০)। চরে নিজেদের জমির অধিকার ফিরে পেতে এ পর্যন্ত শতাধিক বাংলাদেশী আহত হয়েছেন বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে। দীঘ দিনের বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চরের ২.৫ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। ২০১১ সালে বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতর এ সীমানা চিহ্নিতে উদ্যোগ নিলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে উভয় দেশের জরিপ বিভাগ মুহুরীর চরে জরিপ চালায়। মহাপরিচালক পর্যায়ে দু’দেশের জরিপ শেষে সীমানা নির্ধারণ করে কাঠের পিলার স্থাপন করে। সে সময় গওহর রিজভী মুহুরীর চর সফরে এসে বলেছিলেন, ভারতের সংসদে অনুমোদনের পর পাকা সীমানা পিলার স্থাপন হলে মুহুরীর চরের দীর্ঘ দিনের বিরোধ নিষ্পত্তি হবে। দু’দেশের জরিপ দল অস্থায়ী পিলার স্থাপনের পর বাংলাদেশ কমপক্ষে ৬০-৭০ একর জমি ফেরত পেয়েছে বলে এলাকাবাসী ও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
কিন্তু ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে এসেও এখনো সেখানে চাষাবাদ তো দূরের কথা, জমিতে যেতেই পারছেন না বাংলাদেশীরা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যৌথ জরিপ দলের স্থাপন করা অস্থায়ী পিলারের স্থলে স্থায়ী পিলার স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হলেও ভারতের সাড়া মিলছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সার্বভৌম অঞ্চল মুহুরীর চরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভারত দখলে নিয়েছে। উন্নততর প্রকৌশল প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুহুরী নদীতে স্পার ও গ্রোয়েন নির্মাণের মাধ্যমে নদীর গতিধারাকে ভারত ক্রমান্বয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে সুকৌশলে বিলোনিয়ার পাশে নিজ কালিকাপুর গ্রামের মুহুরী নদীর বাঁকে চরের অংশটি মূল চরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ কারণে ক্রমাগত উত্তর অংশে (ভারত) চরের সৃষ্টি হয়ে নদী মোহনা বাংলাদেশের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। দু’দেশের সীমানা হিসেবে মুহুরী নদীর মধ্য গ্রোথকে নির্ধারণ করা হয়।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) আবারো মধ্য গ্রোথকে উভয় দেশের সীমানা হিসেবে নির্ধারণ করে। এরপর ১৯৭৬ সালে ভারত নিজ অঞ্চলের সীমান্ত শহরে বিলোনিয়াকে নদীভাঙন থেকে রক্ষার কথা বলে প্রথমে বাংলাদেশ সীমান্তের কয়েক শ’ মিটার উজানে গ্রোয়েন নির্মাণ করে। আর তখন থেকে মুহুরী নদীর গতিপথ পূর্ব থেকে পশ্চিমে মোড় নিতে শুরু করে। পরশুরামের নিজ কালিকাপুর সীমান্তের ২১৫৯ পিলার থেকে স্থলবন্দরস্থ ২১৬০ পিলার পর্যন্ত মাঝখানে প্রায় ৪৭টি সাবপিলার নদীতে বিলীন হওয়ায় প্রায় ৯২ একর সম্পত্তি বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চর হিসেবে অবস্থিত বলে জানা গেছে। সেখানে জমি হারানো বাংলাদেশীরা নিজেদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করতে চান বলে জানিয়েছেন তারা। বর্তমানে বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চর এলাকায় দু’দেশের জরিপ দলের নির্ধারিত সীমানায় কাঠের পিলার রয়েছে। তবে, দুই অংশেই চাষাবাদ বন্ধ আছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে পরশুরাম উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল হালিম মানিক বলেন, তারা মুহুরী চরের জমির ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে চান, যাতে সেখানে চাষাবাদ শুরু করতে পারেন।
পরশুরাম উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবদুল হালিম বলেছেন, দু’দেশের সীমান্তবাসীর নিরাপত্তা ও দেশের স্বার্থে মুহুরীর চরের জমি নিয়ে বিরোধের দ্রুত সমাধান চান তারা।
বিজিবি-৪-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেছেন, দুই দেশের জরিপদলের নির্ধারিত সীমানায় সীমান্তে কাঠের পিলার রয়েছে। বিরোধীয় জায়গায় কেউ চাষাবাদ করতে পারছে না।