১১ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার

স্বৈরাচার সময়ে বঞ্চিতদের প্রতি আবারো বৈষম্য!

পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পেশ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার কমিটির প্রধান জাকির আহমেদ খান অন্যান্য সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন পেশ করেন।

জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত দাবি করে যেসব কর্মকর্তা আবেদন করেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে ৭৬৪ জনকে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে এসব কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ও মারা যাওয়ায় এসব সরকারি কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পূর্বের বা অতীতের কোনো তারিখ থেকে কোনো বিষয় কার্যকর করা হলে তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ বলা হয়ে থাকে।
আবারো বৈষম্য! : বিগত স্বৈরাচারী আমলে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অনেকেই আবার বৈষম্যের শিকার হলেন, পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হলেন বৈষম্যহীন বাংলাদেশে। পতিত রেজিমের ১৫ বছরে কয়েক হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদোন্নতি বঞ্চিতদের বঞ্চনার প্রতিকারের জন্য সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমদ খানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটি প্রায় তিন মাস পর গতকাল রিপোর্ট দাখিল করেছে।

এর আগে জাকির আহমদ খানের বরাতে পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল যে, কমিটি প্রত্যেক কর্মকর্তার বঞ্চনার মাত্রা অনুযায়ী প্রতিকারের সুপারিশ করবেন। কিন্তু দাখিলকৃত প্রতিবেদনে জাকির আহমদ খান তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বঞ্চনার মাত্রা পরিমাপেও ব্যর্থ হয়েছেন।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, একটি রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট দলবাজ কর্মকর্তারা জাকির আহমদ খানের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের তৈরি তালিকা অনুযায়ী সচিব ও সচিব পদমর্যাদা পদে নিজেদের মতো করে সুপারিশ আদায় করে নিয়েছেন। এতে অনেক বঞ্চিত মেধাবী, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা সচিব ও সচিব পদমর্যাদায় ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ পাননি। বিশেষ করে নিরীহ ও দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কাউকেই সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়নি।

এর আগে জাকির আহমদ খান বলেছিলেন, একটি ব্যাচের সবাইকে তো সচিব করা যাবে না। বিগত রেজিমে কোনো একটি ব্যাচের ৪৪১ জন কর্মকর্তাকে সুপারসিড করে ৪৪২নং সিরিয়ালের অফিসার সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেছিলেন। সুপারসিডেড ৪৪১ জন কর্মকর্তাকে তো সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করা যাবে না। স্বাভাবিক নিয়মে সিনিয়রিটি, দক্ষতা, সততার সুনাম অনুযায়ী যাদের সচিব হওয়ার কথা ছিল, তাদের মধ্যে কেউ সুপারডিডেড হলে তাদের সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করা হবে। জাকির আহমদ খান তার এই নীতিতে শেষ পর্যন্ত অটল থাকতে পারেননি। রাজনৈতিক চাপের কাছে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। দলবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা অনুযায়ী তাকে সুপারিশ করতে হয়েছে। প্রত্যেক ব্যাচের মেধা তালিকার অন্তত প্রথম ৫০ জন সচিব হওয়ার কথা, যদি তারা পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করে থাকেন। ব্যাচের মেধা তালিকায় প্রথম ৫০ জনের মধ্যে থাকা, পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করা অনেক বঞ্চিত সৎ ও দক্ষ কর্মকর্মকর্তাকে তিনি সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেননি।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত বিপ্লবের ফসল। এই বিপ্লবের প্রধান স্টেকহোল্ডার ছিল ছাত্র-জনতা, বিএনপি, জামায়াত ও ছোট কিছু রাজনৈতিক দল। বিগত রেজিমে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ লাগিয়ে যেসব মেধাবী, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেবল একটি বড় রাজনৈতিক দলের ট্যাগ লাগানো দলবাজ অফিসাররাই সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ লাভ করেছেন। জেনুইন অ্যান্ড ডিজার্ভিং হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য ছোট দলের ট্যাগ লাগানো এবং নিরীহ ও দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়নি। বৈষম্যহীন এই বাংলাদেশে অনেক বঞ্চিত, সৎ, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা আবার নতুন করে পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হলেন।

১৫৪০ আবেদন : জানা যায়, নির্ধারিত সময়ে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদনসহ ১ হাজার ৫৪০টি আবেদন জমা পড়েছিল। এর মধ্যে ১৩টি আবেদন নানা কারণে কমিটির আওতার বাইরে ছিল। ফলে কমিটি বাকি ১ হাজার ৫২৭টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ তৈরি করেছে। কমিটি যাদের পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করেছে, তাদের মধ্যে সচিব পদে ১১৯ জন, গ্রেড-১ (সচিবের সমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জন কর্মকর্তা। যেহেতু তারা অবসরে গেছেন, সে জন্য তাদের ‘ভূতাপেক্ষভাবে’ পদোন্নতি দেয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে কমিটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৭৬৪ কর্মকর্তার মধ্যে কমিটি ৯ জনকে ৪ ধাপ, ৩৪ জনকে ৩ ধাপ, ১২৬ জনকে ২ ধাপ এবং ৫৯৫ জনকে ১ ধাপ পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করেছে। অন্য দিকে আবেদন করা ৭৬৩ জন কর্মকর্তাকে কমিটি পদোন্নতির সুপারিশ করেনি। তাদের কেন পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়নি, প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সুনির্দিষ্ট কারণও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার। গত ১৮ আগস্ট একসাথে ২০১ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। তারও আগে ১৩ আগস্ট উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ‘বঞ্চিত’ ১১৭ কর্মকর্তা। যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের পাশাপাশি গত ২৫ আগস্ট অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩১ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/19674399