ব্যবধান মাত্র ২৪ ঘন্টা। কেবল একটি সিদ্ধান্ত। লিটার প্রতি ৮ টাকা দাম বৃদ্ধি। আর দাম বাড়তেই ‘উধাও’ হওয়া সয়াবিন তেলে সয়লাব বাজার। গত কয়েকদিন ধরে দোকানিদের একই কথা ছিল, বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। আর দু-এক জায়গায় পাওয়া গেলেও ছিল বেশি দাম। অথচ গতকাল মঙ্গলবার বাজারে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সব দোকানেই পাওয়া গেল তেল। এর অর্থ এতদিন মানুষকে জিম্মি করে যা করা হয়েছে, তা পুরোটাই সিন্ডিকেটের কারসাজি। কথাগুলো বলছিলেন কারওয়ান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মাহমুদা হোসেন।
ক্রেতারা বলছেন, সংকটের অজুহাতে প্রায়ই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের। বাধ্য হয়ে কিনতে হয় বেশি দামে। কিন্তু যারা দাম বাড়ান, তাদেরও বোঝা উচিত খরচ বাড়লেও আমাদের উপার্জন তো আর বাড়ে না। আসলে তারা মানুষকে মানুষই মনে করে না। বোঝে শুধু অন্যকে জিম্মি করে নিজেদের পকেট ভারি করতে।
সিএনজিচালক সোলাইমানের কথাতেও ক্ষোভ ঝরে। তিনি বলেন, গতকাল সোমবার সকালে এসেও ফিরে গিয়েছি, ১ লিটারের সয়াবিন তেল নাই। অথচ (আজ মঙ্গলবার) দেখছি সব দোকানেই তেল। এইটা কোনো কথা কন ? যার যা ইচ্ছা করবে, কেউ কিচ্ছু বলবে না ? ক্রেতারা বলছেন, যদি সংকটই থাকে তাহলে আজ কোথা থেকে তেল এলো? নাকি দাম বাড়ানোর জন্যই ব্যবসায়ীরা এমনটা করলো ? সরকারের উচিত এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করা।
মঙ্গলবার রাজধানীসহ সারাদেশে সয়লাব বোতলজাত সয়াবিন তেলে। তবে নতুন দরের তেল না আসায় এখনও আগের দামেই তেল কিনতে পারছেন ক্রেতারা।
দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর ডিলাররা বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়িয়েছে বলে মনে করেন অনেক ক্রেতা। তবে নতুন দামের তেল এখনও বাজারে ছাড়া হয়নি। ফলে আগের দামে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬৭ ও ৫ লিটারের বোতল তারা ৮১৮ টাকায় বিক্রি করেন। বিক্রেতারা আরও বলেন, আজ বুধবার থেকে নতুন তেল বাজারে এলে ১৭৫ টাকা লিটার বিক্রি হবে।
এর আগে, সোমবার সারা দেশে বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ৮ টাকা বাড়ানোর কথা জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা আরও বলেন, মূলত এ কারণেই দাম বাড়ানো হয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, সংকটের কোনো কারণ নেই। আমরা বিগত দিনে দেখেছি দেশে ৫ থেকে ৬টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়ে তারা সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয় দাম বাড়ানোর। এবারও সেটাই করা হচ্ছে। রোজা ঘিরে তারা এমন কারসাজি করছে। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত এখন কোম্পনিগুলোর কাছে কী পরিমাণে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল মজুত আছে তার খোঁজ নেওয়া। কোনো অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
তিনি জানান, চাহিদা দিয়েও অনেক কোম্পানির কাছ থেকে চাহিদামাফিক বোতলজাত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। কোম্পানি দিচ্ছে না। যে কারণেও খুচরা বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। যাতে রোজার আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করতে পারে। তাই এখন থেকেই এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।
রামপুরা বাজারের মুদি বিক্রেতা জাহিদ জানান, নবেম্বর মাসে শুরু থেকে বাজার থেকে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তখন ডিলারদের কাছ থেকে প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন ১৮২ টাকায় কিনতে হয়েছে। সে সময় খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করতে হয়েছে ১৮৫ টাকা। তবে অক্টোবর মাসের শেষদিকে তা ১৫৭-১৫৮ টাকায় ডিলারদের কাছ থেকে কিনতাম। খুচরা বিক্রি করতাম ১৬০ টাকা। বর্তমানে দাম কিছুটা কমায় খুচরায় ১৭৫ টাকায় বিক্রি করছি।
ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়াতে ও বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানিতে দুই দফায় শুল্কু-কর কমানো হয়। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক-কর কমিয়ে নামানো হয়েছে শুধু ৫ শতাংশে। তারপরও তেলের বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দাম কমেনি বরং সরবরাহ কমিয়ে সংকট তৈরি করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে দাম। ভোজ্যতেলের বিষয়ে টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তাসলিম জানান, সরকার শুল্ক-কর যা কমিয়েছে, তার চেয়ে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে বেশি। কোম্পানিগুলো লোকসানের ঝুঁকিতে থাকলেও সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। চলতি মাসে সরবরাহ বাড়িয়েছে।