১১ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার

হাসিনার বিচার দাবিতে প্রকম্পিত সোহরাওয়ার্দী

মানবাধিকার সমাবেশে স্বজনহারাদের পাশে সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ

হাজার হাজার স্বজনহারার কান্না আর পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতে সে্লাগানে গতকাল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ এ দাবি তোলেন। নিহত আর নিখোঁজদের স্বজনের বিচার দাবির এই সমাবেশে বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ২০০৬ সালের লগি-বৈঠা তাণ্ডব থেকে শুরু করে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর হত্যাযজ্ঞ এবং জুলাই গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। একই সাথে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে সব দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করারও আহ্বান জানান তারা। তাদের দাবি, সাড়ে ১৫ বছরে ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত সব হত্যা গুম নির্যাতনের বিচার করতে হবে। তারা বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা এখনো প্রতিটি সেক্টরে অবস্থান করছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নুর খান লিটন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরী, সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, আলী আহসান মুজাহিদের ছেলে আলী মাবরুর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলমসহ গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যরা।
সমাবেশে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের দল-মত, আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, রাজনীতি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু এই নিপীড়িত পরিবারগুলোকে, নিপীড়িত মানুষকে এক থাকতে হবে। সেই এক থাকার জন্য আমাদের একটি জাতীয় মঞ্চ গঠন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি। তিনি বলেন, আমাদের সবার কথা আমাদের মানবাধিকার হরণ করা হয়েছিল বিগত সময়গুলোতে, গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। যত দুঃশাসন, লুটপাট হয়েছিল তা তালিকা করলেও শেষ হবে না। আমরা জানি এসব কাজের সাথে কারা জড়িত ছিল। সেই শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ও তাদের মুজিববাদী এবং আদর্শ যেটা একটা ফ্যাসিস্ট রাজনীতি, সেই রাজনীতির ওপর ভিত্তি করেই তারা মানবাধিকার হরণ করেছিল। পুরো বিশ্বকে এটা বলতে হবে যে আওয়ামী লীগ একটা মানবতাবিরোধী দল। তাদের এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে হবে।

নাহিদ ইসলাম বলেন, তারা যে গণহত্যা করেছে এবং এই গণহত্যা শুধু জুলাই আন্দোলনে নয়, ক্ষমতার শুরু থেকেই এই মানবাধিকার হরণ এবং গণহত্যার সাথে জড়িত। শেখ হাসিনার হাতে রক্তের দাগ সবসময় ছিল। যেমনটা ছিল তার বাবার হাতে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি পিলখানা হত্যাকাণ্ড হয়েছে, আমরা দেখেছি শাপলায় কি নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড এবং গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এবং সর্বশেষ জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার ওপর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। আমরা দেখেছি শেখ মুজিব যখন ক্ষমতায় ছিলেন, সেই একইভাবে বাকশাল কায়েম করে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে হরণ করে এবং হত্যা কয়েছিল। তিনি বলেন, কোনো একটি দল ইতিহাসে যখন দুই দুইবার সুযোগ পেল এবং সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথে তারা বারবার মানবাধিকার হরণ করেছে, গণতন্ত্র হরণ করেছে। তার রাজনীতি করার বিষয় আর কোনো দ্বিধা আমাদের কেন থাকবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিদায় হয়ে গিয়েছে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন কারা কারা করবেন এবং করতে চান এখন সেইটা হচ্ছে আলোচনার বিষয়। যারা করতে চান জনগণ তাদেরকেও গণশত্রু হিসেবে চিহিৃত করবে এই বাংলাদেশে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিদায় হয়ে গেছে, এখন প্রশ্ন বিচারের। বিচারের মধ্য দিয়ে আমরা ন্যায়বিচার কায়েম করব। যারা নিপীড়িত হয়েছে, তাদের কাছে আমাদের যে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি ছিল, সেই প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করব। ফলে আমরা যারা নিপীড়িত হয়েছি, সবার একই উক্তির জায়গা ন্যায়বিচার। যে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি হয়েছে, গণহত্যা হয়েছে তার বিচারের জন্য আমরা কাজ করব। তিনি বলেন, খুবই দুঃখের বিষয়, সারা দেশে যারা শহীদ হয়েছে এবং তাদের পরিবারগুলো যে মামলা করেছে, সেই মামলাগুলো নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের আহ্বান থাকবে কোনো দলের কর্মীই যাতে এই মামলাগুলো নিয়ে অপকর্ম না করে। তিনি বলেন, যারা মামলা বাণিজ্য করছে, যারা চাঁদাবাজি করছে, যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও কিন্তু ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ আছে।

নাহিদ ইসলাম বলেন, আজকে বাংলাদেশ একটি নতুন ইতিহাসের পাদতলে দাঁড়িয়েছে। আমরা ভারতকে বলেছি, যে এটা আওয়ামী লীগের বাংলাদেশ নয়, এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশ আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। রক্তের ওপর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে এই বাংলাদেশের সাথে কথা বলতে হবে এবং সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তাই আপনারা এখনো যারা ভারত সরকারে রয়েছেন, ভারতের শাসকগোষ্ঠী রয়েছেন, এই যে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, আপনারা যদি মনে করে থাকেন যে, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড করে বাংলাদেশকে প্রেসারক্রিয়েট করবেন, তাহলে আপনারা ভুল ভাবছেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যখন আমাদেরকে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল আমরা বলেছিলাম যে, আমরা গণভবনে যাবো তবে সংলাপের জন্য নয়, শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার জন্য। তিনি বলেন, আজকে সীমান্তকে যদি সুরক্ষা করতে হয়, তাহলে আমরা সীমান্তেও ছুটে যাবো। তাই আমরা বলতে চাচ্ছি, বাংলাদেশকে নিয়ে যে ধর্ম প্রচার চলছে, এই অপপ্রচার বন্ধ করুন।

মিথ্যা দিয়ে আপনারা এই বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারবেন না। তিনি বলেন, এই জুলাই অভ্যুত্থানে হিন্দু, মুসলমান এক হয়ে আমরা লড়াই করেছি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ এই শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছে। অথচ আমরা দেখেছি ভারত কিন্তু তখন আওয়ামী লীগকে কিছু বলেনি। বিগত আওয়ামী লীগের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বারবার হামলা হয়েছে, কোনো ধরনের বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগের লোকেরাই এই ধরনের হামলার সাথে জড়িত। কিন্তু ভারত কোনো কথা বলেনি। তাই আমার দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, আওয়ামী লীগ ছিল একটি সাম্প্রদায়িক দল, সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী দল। ভারত তাকে সব সময় সমর্থন করে গিয়েছিল। ফলে এই দেশ আমাদের, এই মাটি আমাদের, আমাদেরকে একসাথে ঐক্যবদ্ধভাবে বেঁচে থাকতে হবে, লড়াই করতে হবে। কোনো শক্তি যাতে আমাদের ভেতরে বিভাজন করতে না পারে, সেই বিষয় আমরা সবসময় সচেতন থাকব।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দেশের সমস্ত গুম-খুনের পেছনে রয়েছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। ২০০৬ সালে লগি-বৈঠার হত্যাকাণ্ড, পিলখানা শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, সাজানো মামলা দিয়ে দেশের আলেমদের ফাঁসানো, মৃত্যুদণ্ড দেয়াসহ নিরপরাধদের জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে। দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে খুন করা হয়েছে, ৪০ হাজার আহত করা হয়েছে। এই হাসিনার বিচার করা না হলে আমাদের আন্দোলন, এই ত্যাগ নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ ব্যর্থ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি মানবাধিকার কমিশন আছে, এই ১৬ বছর যে গুম-খুন করা হয়েছে সে ব্যাপারে তারা কি করেছে। আসলে তারাও ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল। তিনি বলেন, ২৪ জুলাইয়ের রক্তের দাম দিতে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে বিদায় দিতে হবে।

বিএনপি নেতা শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি মায়ের ডাককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, একটি ফ্যাসিবাদী শাসক কতটুকু ভয়ঙ্কর হতে পারে গত ১৭ বছরে এই দেশের মানুষ বাস্তবে দেখেছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন, আহত নির্যাতিত হয়েছেন। এই প্রজন্মকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আওয়ামী লীগের ভয়ঙ্কর রাজনীতি শুধু এই ১৭ বছর ছিল না। স্বাধীনতার পরে ’৭২-’৭৫ ধারাবাহিক ফ্যাসিবাদ ছিল। তখনো এই ফ্যাসিবাদের রূপ দেখেছি। এরা গণশত্রুতে পরিণত হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী দেশের সরকার যদি সরাসরি মদদ না দিত তাহলে বাংলাদেশে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ ছিল না। তাদের ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। এই জাতির ঐক্যবদ্ধতাকে ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো তৎপর। তাদের কাছে লুটের টাকা আছে, কিন্তু আমাদের মনোবল সেখানেই। আমরা এক এবং ঐক্যবদ্ধ।

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদ কায়েমে হাসিনাকে যারা ১৫ বছর সর্মথন দিয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। হাজার হাজার মাকে তারা সন্তানহারা করেছে, ’৭১কে পুঁজি করে আওয়ামী লীগকরণের মাধ্যমে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, শত মায়ের বুক খালি করেছে, শত সন্তানকে এতিম করেছে। এই ’৭১ কে পুঁজি করে যাদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা হয়েছে, যাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে তাদের ইজ্জত ফিরিয়ে দিতে হবে। ভারতের প্রেসক্রিপশনে অন্তত এক হাজার আলেমকে তারা হত্যা করেছে। বিনা অপরাধে আলেমদের গ্রেফতার করে যখন আদালতে নেয়া হতো, তাদের কোমরে রশি-হাতে হ্যান্ডকাফ থাকত। অথচ আমরা দেখছি যারা ফ্যাসিবাদী ও তাদের সমর্থন জুগিয়েছে তারা যখন জেল থেকে বের হয়, মনে হয় শ্বশুর বাড়ি থেকে পিকনিক করে বের হচ্ছে। তিনি বলেন, সেদিন যে চিকিৎসক আমার আহত ভাইদের চিকিৎসা দেননি, যে পুলিশ সদস্য অতি উৎসাহী নির্মমভাবে গুলি চালিয়েছে, যে বিজিবির থাকার কথা ছিল সীমান্তে সেই বিজিবি কারা আমার ভাইদের ওপর গুলি চালিয়েছে, যে কলম স্বৈরাচারের গুণগান গেয়েছে সেই কলম ভাঙতে হবে। তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্টগুলো জেলখানাগুলোতে নাকি রাতের বেলায় ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। আবার ফ্যাসিবাদের দোসরদের কৌশলে দেশ থেকে বের হতে সুযোগ করে দেয়া হয়, এটা কিসের আলমত। আসলে আমাদের প্রতিটি সেক্টরে ফ্যাসিবাদের পয়জন রয়ে গেছে। সেগুলো শনাক্ত করতে হবে। প্রশ্নবিদ্ধ এক বিচারের মধ্যে দিয়ে আমার দেশের উল্লেখযোগ্য আলেমদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। স্বৈরাচারের বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই আমাদের উৎখাত করবে। ক্ষমতার লোভে অনেক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করার ধোয়া তুলছে, আপনি যদি মনে করেন ছাত্র-জনতার পিচ্ছিল রক্তের ওপর দিয়ে সংসদে যাবেন তাহলে জাতীয় বেঈমান হিসাবে পরিচিত হবেন। ফ্যাসিবাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বিপ্লব জারি রাখার আহ্বান জানান তিনি।

হুমাম কাদের বলেন, গত ১৬ বছর পরে এ রকম একটি অনুষ্ঠানে আসার অনেক ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আসতে পারিনি। অনেক অনুষ্ঠান লুকিয়ে করতে হয়েছে। তিনি বলেন, গুম খুন আর মামলা শেখ হাসিনার প্রিয় জিনিস। আমার বাবা খুনের শিকার, আমি গুমের শিকার, আমার মা মামলার শিকার। তিনি বলেন, স্বজন হারানোর ব্যথা আমার চেয়ে কেউ বেশি বোঝে না এটি শেখ হাসিনার একটি প্রিয় ডায়ালগ। প্রতিদিন কয়েকবার তার এই নাটক দেখতে হয়েছে। টিভির পর্দায় এই নাটক করে ঘরে বসে খুন-গুমের নির্দেশনা দিত। তিনি বলেন, ভারত সরকার বলেছে অবৈধভাবে আসা বাংলাদেশীদের বের করে দিতে হবে। আমরা তাই চায়, কারণ অবৈধভাবে ফ্যাসিবাদীরা সেখানে অবস্থান করছেন। তাদের বের করে দেন।

সারজিস আলম বলেন, পুলিশকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করেছে আওয়ামী সরকার। তবে দল-মত নির্বিশেষে সবাই যখন ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছে, তখনই শেখ হাসিনা পালাতে বাধ্য হয়েছে। তিনি বলেন, এখনো জুলাই আন্দোলন ঘিরে মামলা বাণিজ্য হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে মামলা হচ্ছে এবং টাকার বিনিময়ে মামলা তোলা হচ্ছে। এ জন্য পুলিশকে সাবধান হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, এখন আগের মতো ভারতের সাথে আর অসমতার সম্পর্ক নয়। কোনো ধর্ম বা জাতির নামে কেউ উগ্রবাদী কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা সফল হতে দেবো না। আমরা কাউকে আবার ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে সুযোগ দেব না। ভারতের কেউ বা বাংলাদেশবিরোধী কেউ যাতে ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেনাবাহিনীকে এ বিষয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

আলী মাবরুর বলেন, আমি একজন এতিম, নির্যাতিত পরিবারের সন্তান। ২০১৫ সালের সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আমার বাবাকে একই রাতে হত্যা করা হয়েছে। বাবার সাথে জেলখানায় দেখা করে বের হওয়ার তিন ঘণ্টা পরই শুনে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। একটি মানুষকে জীবিত দেখে এসেছি। অথচ তিন ঘণ্টা পর শুনে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য দেশের আইন সংশোধন করেছিল। যারা এই হত্যাকাণ্ডের আইন সংশোধন করে অন্যায় করেছিল এবং এই অন্যায়ের সাথে যারা জড়িত ছিল যারা নীলনকশা করেছিল আজকের এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের সবার বিচার দাবি করছি। এই বিচার যদি না হয় তাহলে বাংলাদেশে সাড়ে ১৫ বছরে যে অগণিত মানুষ ভিকটিম হয়েছেন, যতগুলো হত্যাকাণ্ড সেই হত্যা বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, আমরা যে পৈশাচিকতা দেখেছি আল্লাহ এই জুলাই আগস্টের বিপ্লবের মাধ্যমে তার থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন। তার জন্য সব ছাত্র-জনতার প্রতি কতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

নুর খান লিটন বলেন, ৭৩তম মানবাধিকার দিবস যে উন্মুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে সমাবেশ করতে পারছি ৩৬ জুলাইয়ের সুফল। গত বছরও মুক্তভাবে স্বাধীনভাবে মানবাধিকার দিবস পালন করতে পারিনি। নানা ধরনের বাধার মুখে আমাদের মানবাধিকার দিবস পালন করতে হয়েছে। তিনি বলেন, মানবাধিকার কর্মী হিসাবে বলতে চাই গত সাড়ে ১৫ বছর, যেভাবে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে নির্যাতন করা হয়েছে, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীর অনুষ্ঠানে যেভাবে গণহত্যা করা হয়েছে, এমনকি সমাবেশ থেকে যখন বাড়ি ফিরছিল কুমিল্লায় ট্রেন থেকে হেফাজত কর্মীদের নামিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল।

আপনারা দেখেছেন বুয়েটের একজন ছাত্রের লাশ বুড়িগঙ্গায় এসবই ওই গণহত্যারই চিহ্ন। এই সাড়ে ১৫ বছর মানুষ কথা বলতে পারিনি। আমাদের একটি ভয়ের চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছিল। আমরা গুমের খবর জানি, খুনের খবর জানি, মানুষ অনেককে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নেয়ার খবর জানি। যারা ফিরে এসেছে, তারাও ভয়ে কথা বলেননি। নুর খান বলেন, গোপন কারাগার, গোপন সেলে মাত্র সোয়া ৩ ফিট জায়গার মধ্যে এবং তারই পাশে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ তিন ফিট জায়গার মধ্যে একটি মানুষকে বন্দী করা রাখা হয়েছে। তাও আবার মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। ওই বন্দী মানুষ জানেন না কতদিন ধরে তিনি আছেন। তাকে দিন গণনা করতে হয়েছে সকালে যখন নাশতা দেয়া হয়েছে রুটি অথবা খিচুড়ি তখন থেকেই তিনি দিন গণনা করতে পেরেছেন। আমরা তদন্ত করতে গিয়ে দেখলাম ওই ছোট্ট দেয়ালের কোথাও কোথাও লেখা আছে, ‘আই লাভ মাই কান্ট্রি, আই লাভ মাই ফ্যামিলি। কেউ কেউ বিভিন্ন সুরা লিখে রেখেছেন। কেউ মোবাইল ফোন নম্বর লিখেছেন। আমরা চেষ্টা করছি ওই জায়গাগুলো যা পাচ্ছি তা ধরে শনাক্ত করা। যে মানুষগুলো এই গুম খুনের সাথে যুক্ত তাদের চিহ্নিত করতে। আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই আপনাদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরতে পারব।

জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ২০০৬ সালে গত ২৮ অক্টোবর পল্টন ময়দানে শেখ হাসিনার আহবানে সারা দেশ থেকে লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল, সেদিন ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল। মঈন-উদ্দিন ফখরুদ্দীনের সহযোগিতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সেই ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী করতে পাটাতন গেড়েছিল। ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে হত্যা করে দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। ২০১৩ সালে হেফাজত নেতাকর্মী হত্যাসহ, বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীদের ফাঁসি দেয়াসহ অসংখ্য মানুষকে বিচারবর্হিভূতভাবে গুম খুন করেছে তারা। ভোট কারচুপির মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল। ২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেই ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটেছে। পতিত ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্র নির্মূলে আমাদের জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান তিনি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/19674401