প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষকের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। জমিতে রোপণের পর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সরবরাহ করা বারি-১, বারি-৪ ও তাহেরপুরী জাতের বীজের ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত গজায়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিগ্রস্তরা মানববন্ধন পর্যন্ত করেছেন। বিএডিসি থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কারা এই মানহীন বীজ সরবরাহ করেছেন তা বের করতে মাঠে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বিএডিসির চেয়ারম্যান রুহুল আমিন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ফরিদপুর ও পাবনায় বীজ অঙ্কুরিত হয়নি বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তারা মাঠ পিরিদর্শন করেছে। এখনো রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট দিলে জানা যাবে কারা দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান নয়া দিগন্তকে জানান, প্রণোদনার মাধ্যমে সরবরাহকৃত পেঁয়াজ বীজে বিভিন্ন জায়গায় অঙ্কুরোদগম ঠিকমতো হয়নি বলে জেনেছি। জানার পরপরই জরুরি ভিত্তিতে স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসা হয়েছে। উপদেষ্টাসহ আমরা বসে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যেহেতু সময় শেষ, কৃষকদের মধ্যে আমরা আবার উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করব। লাল তীর কোম্পানির বীজ নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কৃষককে সরবরাহের সিদ্ধান্ত হয়। মোট ৯ মেট্রিক টন আমরা নেব। ইতোমধ্যে আমরা ৪ হাজার ৭০০ কেজি (প্রায় সাড়ে ৪ টন) পেয়েছি। এগুলো দুই জেলায় ভাগ করে দিয়েছি। বাকিটা সোমবার (৯ ডিসেম্বর) আসছে। যেখানে যেখানে সমস্যা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সেগুলো কৃষককে সরবরাহ করব।
তিনি বলেন, এটা নিয়ে (বীজ না গজানো) কয়েকবার মিটিং করেছি। তদন্ত করা হয়েছি। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আমাদের কোনো কর্মকর্তা দায়ী থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। আর কোন কোম্পানি বীজ দিয়েছে, সেটাও যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। তবে, এই মুহূর্তে আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে কিভাবে দ্রুততার সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে আবার বীজ পৌঁছে দেয়া যায়।
এ দিকে গত কয়েক বছর কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসির একটি সিন্ডিকেট প্রণোদনার জন্য গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজবীজসহ অন্যান্য ফসলের বীজ আমদানিতে লুটপাট করেছে। দ্বিগুণেরও বেশি দামে ভারত থেকে এন-৫৩ পেঁয়াজ বীজ আমদানি করে কৃষককে সরবরাহ করছে চক্রটি। এ নিয়ে গত ৩ নভেম্বর নয়া দিগন্তে ‘প্রণোদনার বীজ আমদানিতে লুটপাট’ শিরোনামে তথ্যভিত্তিক খবর প্রকাশিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ নিয়ে কৃষি সচিব বলেন, বীজ সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য আমরা সেখানে ঢুকতেছি। সার এবং বীজে কী সমস্যা আমরা দেখতে চাই।
জানা যায়, দেশের অন্যতম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলা ফরিদপুর। এ জেলায় প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। সেই লক্ষ্যে প্রতি বছর সরকারিভাবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে পেঁয়াজ বীজ বিতরণ করা হয়। জানা গেছে, চলতি রবি মৌসুমে ৫ হাজার ২০০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে তাহেরপুরী, বারি পেঁয়াজ-৪ ও ৬ জাতের পেঁয়াজ বীজ বিতরণ করা হয়েছে। প্রণোদনা হিসেবে জনপ্রতি এক কেজি পেঁয়াজ বীজের সাথে ২০ কেজি সারও বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে তাহেরপুরী জাতের ৪ হাজার ও বারি জাতের ১২ শ’ কেজি বীজ বিতরণ করা হয়েছে। তবে এবার প্রণোদনা পাওয়া পেঁয়াজ বীজের বেশির ভাগই অঙ্কুরিত না হওয়ায়, কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, ২০-৩০ শতাংশ বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে বলে সরজমিনে প্রমাণ পেয়েছেন। যার হার মোটেও সন্তোষজনক নয়।
দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের আরেক শীর্ষ জেলা রাজবাড়ী। এ জেলার কৃষকরা মোট আবাদের প্রায় ১২ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদন করেন। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বিএডিসি সরবরাহকৃত পেঁয়াজের বীজে (পেঁয়াজের দানা) জেলার কয়েকটি উপজেলার ৪ হাজার কৃষকের মাঝে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বিনামূল্যে বীজ বিতরণ করে। বীজতলায় ২০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও বীজের অঙ্কুরোদগম হয়নি বলে দাবি করেছেন কৃষকরা। জেলায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। মানহীন বীজের কারণে এ বছর ৭ থেকে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ কম হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
জানা যায়, রাজবাড়ীতে শুধু এবার নয়, গত বছরও প্রণোদনার মানহীন বীজে কৃষকরা প্রতারিত হয়েছেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো: হোসেন শহীদ সরোওয়ার্দী গতকাল সন্ধায় নয়া দিগন্তকে বলেন, চলতি মৌসুমে চার হাজার কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বিএডিসি থেকে সরবরাহকৃত পেঁয়াজের বীজ বিতরণ করা হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম হয়নি। এর বেশির ভাগই বারি-৪ জাতের বীজ।
এ দিকে মাগুরা, গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজে কৃষকের সর্বনাশের খবর পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন জায়গায় প্রণোদনার মানহীন বীজে কৃষকের সর্বনাশ হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাই বিএডিসির কিছু অসাধু কর্মকর্তা অল্পদামে মানহীন বীজ কিনে সংশ্লিষ্টদের সাথে আঁতাত করে প্রণোদনার অর্থ লোপাট করে যাচ্ছেন।