সিরিয়া ছেড়ে পালিয়েছে স্বৈরাচার বাশার আল আসাদ। দীর্ঘ ২৪ বছর দেশ ও জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থেকে অবশেষে বাংলাদেশের হাসিনার স্টাইলেই পালাতে হলো বাশার আল আসাদকে। এর আগে অবশ্য আরও অনেকেই পালিয়েছেন্ যারা পালাতে পারেননি তাদের পরিণতি নির্মম হয়েছে বটে। তবুও কেন যেন সেই নির্মমতা থেকে শিক্ষা নেয় না মানুষ। ক্ষমতাকে আকড়ে ধরে রাখার জন্য জগন্য যতো কাজ আছে সব ব্যবহার করে।
বার্তা সংস্থা আল জাজিরার খবরে গতকাল বিকাল পর্যন্ত বলা হয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশারকে বহনকারী বিমানে অজানা গন্তব্যে উড়াল দিয়েছে। বিদ্রোহীরা রাজধানী নিয়ন্ত্রণে নেয়ার আগে দামেস্ক থেকে সর্বশেষ যে ফ্লাইটটি ছেড়ে যায়, সেটি ছিল ইলইউশিন ৭৬ নামক একটি বিমান। এর নম্বর ছিল ৯২১৮। ওপেন সোর্স ফ্লাইট ট্রেকার্স জানিয়েছে, বিদ্রোহীরা হোমস শহর দখলের সামান্য কিছু সময় আগে ওই ফ্লাইটের সঙ্কেত অদৃশ্য হয়ে গেছে। এদিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা এই অভিযানের নেতৃত্বে আছে তাদের টেলিগ্রাম হ্যান্ডেলে বলেছে, বাশারের দেশ ছাড়ার মাধ্যমে একটি অন্ধকার যুগের অবসান ঘটেছে এবং এক নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে। দামেস্কের পথে পথে বিপুলসংখ্যক মানুষকে উল্লাস করতে দেখা গেছে।
আমরা যদি ঘটনা পরম্পরা দেখি একই স্টাইলে হেলিকপ্টারে উড়াল দিয়েছিল বাংলার স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। তার পলায়নের পর বাংলাদেশের একটি অন্ধকার যুগের অবসান হয়। নতুন যুগের সুচনা হয়। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় বিপুল সংখ্যক মানুষ উল্লাস করে। গণভবনে প্রবেশ করে কেউ লুটপাট করে। আবার কেউ স্বৈরাচার বিতাড়িত হওয়ায় মহান প্রভুর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে সেজদায় মাথা অবনত করে।
ভেঙে ফেলা হয় আসাদের বাবা সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদের ভাস্কর্য। ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়। ওই বছরই সিরিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তার ছেলে বাশার আল-আসাদ।
তার আমলেই ২০১১ সালে সিরিয়ায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। মিত্র রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় কয়েক বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হন বাশার আল-আসাদ। যদিও আনুষ্ঠানিক কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি। কয়েক বছর পর গত ২৭ নবেম্বর আসাদ বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা শুরু করেন সিরিয়ার বিদ্রোহীরা। হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এবারের আক্রমণের গতি এতোই দ্রুত ছিল যে সরকারি বাহিনী তাদের সামনে কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
এবার অভিযান শুরুর মাত্র ১২ দিনের মাথায় তারা রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করেন শনিবার দামেস্ক থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জেরমানা শহরতলির কেন্দ্রে থাকা হাফিজ আল-আসাদের একটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেন বিক্ষুব্ধ জনতা। ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগই আরেক শহরতলি দ্রুজের বাসিন্দা। তারা সে সময় ফাঁকা গুলী ছোড়েন ও আসাদের পতন দাবি করেন।
বাশার আল আসাদের শাসন ব্যবস্থাটা হাসিনার মতো ছিল। ঠিক উল্টো কলে বললে আশাদের কাছ থেকে হাসিনা দীক্ষা নিয়েছিলেন। কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণ ও বিরোধীদল সমুহের ওপর অত্যাচারে স্টিমরোলার চালাতে হয়। অন্য আরব দেশের মতো সিরিয়াতেও গণতন্ত্র ছিলো না ও বহুদলীয় নির্বাচন হতো না। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সেখানকার সব দেশেই আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল।
হাফিজ আল-আসাদ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে উঠে আসেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাথ পার্টির সরকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। পরে দেশের প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭১ সালে। এরপর ২০০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ওই পদেই বহাল ছিলেন। তার সময়ে অনেকগুলো সামরিক অভ্যুত্থান হলেও তা সফল হয়নি। বরং বিরোধীদের দমন ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তিনি কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছেন।
অবশ্য রাজনীতি ও সামরিক বাহিনী থেকে দূরে থাকতে বাশার আল-আসাদ ডাক্তার হিসেবেই তার ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েশন শেষে তিনি ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যে যান লন্ডনের ওয়েস্টার্ন আই হসপিটালে চোখের ডাক্তার হিসেবে পড়ালেখার জন্য। এ সময় তিনি ইংরেজ গায়ক ফিল কলিন্সের অনুরক্ত হন ও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হন।
উদাহরণ টানলে দেখা যায় শেখ মুজিবের হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার পর যেমন শেখ হাসিনার জীবনের গতিপথ বদল হয় তেমনি বাশার আল আসাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে যায় বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওই মৃত্যুই মূলত বাশার আল-আসাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ তাকে ফিরে যেতে হয় সিরিয়ায় এবং এরপর তাকে সিরিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়। বাশার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং ভবিষ্যতের জন্য জনগণের সামনে নিজের ইমেজ তৈরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
দায়িত্ব নিয়ে তিনি “স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন, জবাবদিহিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনা”র কথা বলেছিলেন। প্রথম দিকে তার রাজনৈতিক সংস্কার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক বক্তব্য অনেককে আশাবাদী করেছিল। তার নেতৃত্বের স্টাইল ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আসমার সাথে জুটিবদ্ধ হওয়া- অনেককে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ২০০১ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান চালায় ও বহু সোচ্চার কণ্ঠকে আটক করে। বাশার আল-আসাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত সংস্কার করলে ব্যক্তি খাত উৎসাহী হয়ে ওঠে। তবে তার শাসনের প্রথম দিকে উত্থান হয় তার চাচাতো ভাই রামি মাখলৌফের। তিনি সম্পদ আর ক্ষমতার সমন্বয়ে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন।
তার শাসনামলে সংঘাত বেড়ে যাওয়ার পর জাতিসংঘের হিসেবে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। একইসাথে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রাশিয়া, ইরান এবং ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আসাদের বাহিনীকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিডিআর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মতিঝিলে হেফাজত হত্যাকান্ড সহ বহু মানুষকে হতাহত করে শেখ হাসিনার নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। তাও করা হয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইন্দনে।
শেষ করি এই কথা দিয়ে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান বাংলাদেশের স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। ইতি ঘটে তার টানা ১৬ বছরের শাসনের। এই ঘটনার মাত্র চার মাস পর আরেক স্বৈরশাসকের পতন দেখলো বিশ্ব। গতকাল রোববার বিদ্রোহীদের সশস্ত্র অভিযানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। পতন হয়েছে তার টানা দুই যুগ শাসনের। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা দামেস্ক ঢুকে পড়ে এবং বাশার আল-আসাদ ব্যক্তিগত বিমানে করে অজানা গন্তব্যে চলে যান। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর মাধ্যমেই অবসান হলো সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের। সম্ভবত এটাই স্বৈরাচার পালানোর স্টাইল।