৯ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার

মিথ্যা সাক্ষ্যে যেভাবে ট্রাইব্যুনালের রায় অবয়ব পেয়েছিল

-এহসান এ. সিদ্দিক

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যবহার শুধু মাঝে মধ্যে ঘটেছে এমন নয়; এটি ছিল একটি বিস্তৃত সমস্যা- যা পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত করে। যখন ডিফেন্স পক্ষ প্রসিকিউশনের সাক্ষ্যের মধ্যে বারবার অসঙ্গতি তুলে ধরছিল, তখন অপ্রাসঙ্গিকভাবে ক্রস-এক্সামিনেশন হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। এর একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো, সাক্ষ্য যে মিথ্যা তা প্রমাণিত হওয়ার মুখে আপিল বিভাগ, দোষী সাব্যস্ত করতে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণিত হওয়া ছাড়াই সত্য বলে ধরে নেয়। এ প্রবণতা বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করে। আর তদন্তকারী, প্রসিকিউটর, সাক্ষী এমনকি বিচারকদেরও অন্যায়ের সহযোগী এজেন্টে রূপান্তরিত করে। এ নিবন্ধে পদ্ধতিগত ব্যর্থতাগুলো দেখা হয়েছে, যা এ বিচারকে কলুষিত করেছিল।

নয়া দিগন্তে প্রকাশিত গত কয়েকটি নিবন্ধে আলোচনা করেছি, ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা এবং তৎকালীন আপিল বিভাগ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে কিভাবে আইনের অপব্যবহার করেছেন। আলোচনা করেছি, কিভাবে ক্রস-এক্সামিনেশনের নিয়ম পরিবর্তন করা হয় এবং কিভাবে শুধু দোষী সাব্যস্ত করার একটি রায় দিতে আন্তর্জাতিক আইনের সুপরিচিত নীতিগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। আজ আলোচনা করতে চাই কিভাবে তদন্তকারী, প্রসিকিউটর ও বিচারকরা মিথ্যা প্রমাণ তৈরি ও উপস্থাপন করেছিল ।

জামায়াতে ইসলামীর একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো সামনে চলে আসে। এ মামলায় আমি অভিযুক্ত পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছি। এ মামলায় প্রথম সাক্ষী মো: হামিদুল হক নিজেকে মুজিব বাহিনীর সদস্য বলে দাবি করেন। প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ করেন। তার দেয়া সাক্ষ্যে তার নিজের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে সন্দেহের জন্ম দেয়। জেরা করার সময় ৩০৩ রাইফেল সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব তিনি দিতে পারেননি। এতে যুদ্ধে আদৌ তিনি অংশ নিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। তিনি ৩০৩ রাইফেলের একটি ম্যাগজিনে কতগুলো বুলেট সংরক্ষণ করা যেতে পারে এমন একেবারে প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেননি। ট্রাইব্যুনাল এটিকে অপ্রাসঙ্গিক বলে বর্ণনা করে আমাদের ক্রস পরীক্ষা বন্ধ করে দেন। তবে, ক্রস-এক্সামিনেশনে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে সাক্ষী মোটেই বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন না। এভিডেন্স অ্যাক্ট-১৮৭২ এর অধীনে এ ধরনের প্রশ্ন করার অনুমতি রয়েছে। তবে এভিডেন্স অ্যাক্ট প্রযোজ্য ছিল না বলে উল্লেখ করে, আমাদের জেরা আকস্মিকভাবে শেষ করে দেয়া হয়।

প্রসিকিউশনের সবচেয়ে উদ্ভট সাক্ষীদের মধ্যে একজন ছিলেন মোহন মুন্সি, যিনি নিজেকে একজন খণ্ডকালীন চাঁদাবাজ ও সাবেক দর্জি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি সাক্ষ্য দেন যে, তিনি প্রথমে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিলেও পরে আলবদরে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে যোগ দেন। কর্তব্য এড়াতে অসুস্থতার ছলনা করেন। ডাক্তারদের বলেন, তিনি একজন হোমিওপ্যাথের দেয়া গ্লুকোজের তীব্র প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছেন। নিজেকে কামারুজ্জামানের চাকর বলে দাবি করে তিনি উদ্ভট বক্তব্য দেন, যেমন ১৭ বছর বয়সী কামারুজ্জামান ও অধ্যাপক গোলাম আযমের মধ্যে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের অভিযোগ আনেন। ক্রস পরীক্ষায় প্রকাশ পায়, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তার ছেলে সম্প্রতি একটি সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এতে তার উদ্দেশ্য নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। তার অযৌক্তিক সাক্ষ্য ও কথাবার্তায় প্রায়ই আদালত কক্ষে হাসির সৃষ্টি হয়। তিনি জানান, তার পাঁচ স্ত্রী রয়েছেন এবং তার আলবদর সম্পৃক্ততায় বউদের সমস্যাকে তিনি দায়ী করেন।

কামারুজ্জামানের মামলার আরেক সাক্ষী ছিলেন জিয়াউল ইসলাম, যিনি নিজেকে ১৯৭১ সালে ভারতে ব্রিজ ভাঙার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন। তবে প্রাথমিকভাবে তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি তালিকা থেকে বাদ পড়ে তার প্রমাণপত্রে সন্দেহ দেখা দেয়ায়। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে তার অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেয়ার বিষয়ে তার প্রস্তুতির কথা জানান ডিফেন্স আইনজীবীদের কাছে। প্রসিকিউশন তাকে ৩০৩ রাইফেল সংক্রান্ত প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু এর পরিবর্তে তাকে সেতু ধ্বংসের একটি আর্মি ম্যানুয়াল থেকে দু’টি প্রাথমিক প্রশ্ন করা হয়- একটি সফল ধ্বংসের জন্য ১. সেতুর ন্যূনতম দৈর্ঘ্য এবং ২. বিস্ফোরকগুলোর যথাযথ স্থাপন কেমন হতে হয়। জবাব দেয়ার ব্যাপারে তার যথেষ্ট প্রশিক্ষণের দাবি সত্ত্বেও, তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।
বিচারের মাঝপথে প্রসিকিউটররা বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের বিদ্যমান প্রমাণগুলো শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নৃশংস ঘটনা সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করতে অপর্যাপ্ত। এ ঘটনায় আগে ঠাণ্ডা মাথায় পুরুষদের হত্যা করে পরে তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। এ ঘটনার কুখ্যাতি থাকা সত্ত্বেও জামায়াত এবং কামারুজ্জামানসহ এর কোনো নেতাকে লক্ষ্যবস্তু করার মতো ঐতিহাসিক বিবরণ নেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির। কোনো ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী বা তদন্তকারী তাকে গণহত্যার সাথে যুক্ত করেননি। এ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে, প্রসিকিউশন বিচার স্থগিত করে এবং অপরাধমূলক প্রমাণ খুঁজে পেতে সোহাগপুরে ভ্রমণ করে। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম একাধিক নতুন সাক্ষীর জবানবন্দী নিয়ে ফিরে আসেন, সবগুলোতে কেবল প্রথমবারের মতো কামারুজ্জামানকে জড়িত করে নেয়া হয়। এসব বিবৃতির শৈলী ও ভাষা স্পষ্টভাবে অভিন্ন ছিল, যা তাদের সত্যতা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ সৃষ্টি করে। ট্রাইব্যুনাল এ আকস্মিক প্রমাণ সংগ্রহের সন্দেহজনক প্রকৃতি সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে সচেতন ছিলেন। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটর যে শেরপুরে সাক্ষ্য-প্রমাণ তৈরি করতে গিয়েছিলেন, তা আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি।

তারপর এমন কিছু উদাহরণ পাওয়া যায় যখন ট্রাইব্যুনাল একটি বইয়ের পরিবর্তে অন্য বইকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কামারুজ্জামানের মামলায় ট্রাইব্যুনাল অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের লেখা ‘একাত্তরের বিজয়গাথা’ পছন্দ করেছিল, সেটির পরিবর্তে পরে শাহরিয়ার কবির (যদিও তিনি অ্যাকাডেমিক বা ইতিহাসবিদ নন) রচিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইটির ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নেন। ট্রাইব্যুনাল শাহরিয়ার কবিরের বইটিকে অধিকতর ‘অনুমোদিত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যদিও এতে উদ্ধৃতির কোনো উল্লেখ নেই, কারণ বইটিতে কামারুজ্জামানকে আলবদরের প্রধান সংগঠক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

প্রশ্নবিদ্ধ অন্য বইটির লেখক ছিলেন অ্যাকাডেমিক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, যিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে- পদক উভয়ই পেয়েছেন। জামায়াতবিরোধী অবস্থানের সুনিপুণ দলিল থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক মামুনের কাজগুলোতে কামারুজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো অপরাধে জড়িত করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল মামুনের বইটি খারিজ করে দেন এই যুক্তিতে যে, এটিতে প্রামাণিক সূত্রের উল্লেখ নেই এবং তাই গবেষণা হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায় না। এটি ট্রাইব্যুনালের নন-অ্যাকাডেমিক লেখার ওপর পছন্দমতো নির্ভরতাকে হাইলাইট করে, যখন প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক কাজগুলোকে উপেক্ষা করে তাদের অপরাধ বর্ণনায় উপযুক্ত বা অনুকূল বই বেছে নেয়া হয়।

একজন ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে লক্ষ্য করেছি, সাক্ষীদের দ্বারা মিথ্যা প্রমাণের ব্যাপক উপস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের আইন দ্বারা বাধ্যতামূলক ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াকে দায়ী করা যেতে পারে। খ্রিষ্টান সাক্ষীদের বিপরীতে হিন্দু ও মুসলিমসহ অ-খ্রিষ্টান সাক্ষীদের ধর্মীয় পাঠ্যের ওপর শপথ নেয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের সাক্ষ্যের সাথে জড়িত ধর্মীয় পবিত্রতার এ অভাব সত্য কথা বলার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বাধ্যবাধকতা কমিয়ে দেয়। এ আইনি কাঠামোটি শপথ আইন-১৮৭৩ প্রণয়ন থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা শুধু খ্রিষ্টানদের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থে শপথ করার বিশেষাধিকার সীমাবদ্ধ করে দেয়। শপথ আইন-১৮৭৩ কার্যকর হওয়ার পর, এলাহাবাদ হাইকোর্ট, সম্রাজ্ঞী বনাম মারু (১৮৮৮) মামলায় ব্রিটিশ ভারতের বিচার ব্যবস্থায় এ পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা স্বীকার করে। আদালত পর্যবেক্ষণ করেছে যে, হিন্দু ও মুসলিম সাক্ষীদের জন্য ধর্মীয় শপথ বর্জন করা আদালতের সত্য সাক্ষ্য নিশ্চিত করার ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করেছে, যা একই সাথে বিচার প্রশাসনকে দুর্বল করে।

একটি ন্যায্য বিচার খাঁটি ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণের ওপর নির্ভর করে। আর প্রসিকিউশন, তদন্তকারী এবং স্বয়ং ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব উপস্থাপিত প্রমাণগুলোর জাতীয় মানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, তা নিশ্চিত করা। বানোয়াট বা সন্দেহজনক প্রমাণের বারবার ব্যবহার শুধু বিচারিক প্রক্রিয়াকে নয়; বরং ন্যায়বিচারের জন্য দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থাকেও ক্ষুণ্ন করে। তদন্তকারীদের অবশ্যই সত্য উদঘাটনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে, প্রসিকিউটরদের বিশ্বাসযোগ্য ও যাচাইযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে মামলা উপস্থাপন করতে হবে। ট্রাইব্যুনালকে অবশ্যই অনুমানের চেয়ে প্রকৃত প্রমাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে।

সত্য প্রমাণ ন্যায়বিচারের ভিত্তি। এটি ছাড়া, বিচার নিছক প্রদর্শন বা কৃতিত্ব জাহিরে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। তা এমন ফল তৈরি করে, যা বিশ্বাসযোগ্য বা বৈধ নয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সব অংশীজনের, শুধু একক কারো নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জন্য, এর অর্থ অতীতের অসদাচরণের ছায়া থেকে মুক্ত হওয়া এবং ন্যায়বিচার ও সত্যের নীতিগুলো সমুন্নত রাখতে প্রচেষ্টা গ্রহণ করা; যাতে সততা বজায় রেখে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং হেগের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজের নিবন্ধিত আইনজীবী

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/19673679