ঢাকা-দিল্লী সম্পর্কে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইছে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন ও উত্তেজনার মধ্যে আগামীকাল সোমবার দুই দেশের পূর্বনির্ধারিত পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে চলছে। এদিকে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফর নিশ্চিত করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত শুক্রবার সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোওয়াল জানান, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ৯ ডিসেম্বর এক দিনের জন্য ঢাকা সফরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত নানাবিধ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে তার আলোচনা হবে বলে জানান তিনি। ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর প্রায় চার মাস ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লী সম্পর্কে টানাপোড়েন চলে আসছিল। তবে সেই টানাপোড়েন থেকে এখন দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হয়েছে। ভারতের পত্রিকাগুলোর লিড নিউজ এখন বাংলাদেশ। উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো। তার ফলে দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা ও জাতীয় পতাকা পোড়ানোর ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনার জেরে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। এ দিন বিকেল চারটার কিছু আগে প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব এম রিয়াজ হামিদুল্লাহর দপ্তরে তাকে তলব করা হয়।
বাংলাদেশ-ভারত বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লী সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পতন হওয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়, কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা ও জাতীয় পতাকা পোড়ানো, বন্যার পানি, সীমান্ত হত্যা, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর উসকানিমূলক বক্তব্য, সংখ্যালঘু দিয়ে উসকানি, ইলিশ রপ্তানি ইত্যাদি নানা ইস্যুতে বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের টানাপোড়েন চলছে। এভাবে দু’প্রতিবেশি দেশ চলতে পারে না। কারণ ভারত ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। বাংলাদেশীদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত একজন হত্যাকারী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভারতীয় মিডিয়াগুলো প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে, এর শেষ কোথায়?
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোওয়াল জানান, ভারত-বাংলাদেশের ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন’ (এফওসি) আলোচনা কাঠামোয় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের এই আলোচনা হবে বলে জানানো হয়েছে। দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। ঢাকা থাকাকালীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা বৈঠক হবে কি না, সে বিষয়ে মুখপাত্র স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, এফওসির বৈঠক ছাড়াও আরও অনেকের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের আলোচনা হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলে আসছিল। তবে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তারের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে অস্বস্তি শুরু হয়। চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তারের পর প্রথমে ভারতের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়া হয়। সেই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় অপরাধীরা যেখানে ধরাছোঁয়ার বাইরে সেখানে একজন ধর্মীয় নেতা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন কথা বলেছেন, তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বলে, ভারতের এ ধরনের ভিত্তিহীন বিবৃতি শুধু ভুল তথ্য ছড়ানো নয়, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থি।
ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি অভিন্ন স্থল সীমান্ত রয়েছে। এছাড়াও, সমুদ্রসীমা আছে দুই দেশের মধ্যে। বড় ধরনের বাণিজ্য আছে প্রতিবেশি দুই দেশের মধ্যে। কানেকটিভিটি ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বিদ্যমান দুই প্রতিবেশির মধ্যে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ার পর সম্পর্কের সেই গতি ধরে রাখাও চ্যালেঞ্জ।
আলিফ হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন আদালতসহ গোটা বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মামলা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণ ভাবনা সংস্থা ইসকন নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতে লংকাকান্ড ঘটে চলেছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেবার দাবি জানিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। উগ্র হিন্দু গোষ্ঠীগুলো ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনসমূহ ঘেরাও করছে। কথা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গেুর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় দাঁড়িয়ে মমতা বলেন, হিংসা ও ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে তিনি দুঃখিত। তবে বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে সুরাহা হতে হবে।
এই ঘটনায় হঠাৎ করেই সামনে চলে আসে ইসকনের নাম। ইসকন নিষিদ্ধ করার দাবি উঠতে থাকে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের সঙ্গে ইসকন নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন আসছে কেন এই প্রশ্নে জানা গেল, চিন্ময় একদা ইসকনের পুরোহিত ছিলেন। ইসকনের অভ্যন্তরীণ কারণে চিন্ময়কে বহিষ্কার করা হয় কয়েক মাস আগে। তারপর তিনি সনাতনী জাগরণ জোটের নেতা হয়ে ওঠেন। বয়সে তরুণ এই পুরোহিত হিন্দু তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার বক্তব্য শোনার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ সমবেত হন। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আট দফা দাবির পক্ষে এক ধরনের উন্মাদনার সৃষ্টি করেন। চিন্ময়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপরে গেরুয়া পতাকা টাঙ্গিয়েছেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ।
এরপর ২৮ নবেম্বর কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ নামে একটি উগ্রবাদী সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সমাবেশের ব্যারিকেড ভেঙে মিশনে হামলার চেষ্টা চালায় ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কুশপুতুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পরদিন ২৯ নবেম্বর ঢাকা বিবৃতি দিয়ে কড়া প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়। বিবৃতিতে ভারতের সব বাংলাদেশ মিশনের নিরাপত্তার আহ্বান জানানো হয়। এরপর ২ ডিসেম্বর আগরতলার বাংলাদেশ মিশনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকে উগ্রবাদী সংগঠন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি। সংগঠনের সদস্যরা ব্যারিকেড ভেঙে মিশনে হামলা চালায় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে। ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে যথাযথ তদন্ত দাবি করেছে। এ ছাড়া চলমান ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে যখন দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলে আসছিল, এরমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর আহ্বান জানান। এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও অসন্তোষ জানিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। সংখ্যালঘুদের নিয়ে যেন কোনোভাবেই বিভ্রান্তি না ছড়ায়, সে বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে ২ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকাস্থ বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে ব্রিফ করেন তিনি। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন ঢাকার বিদেশী কূটনীতিকদের ব্রিফ করছিলেন, ঠিক তখনই আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনা ঘটছিল।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র পদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে প্রকৃতপক্ষেই দুই দেশের সম্পর্কে সমস্যা চলছে। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। তবে আমরা স্বাভাবিক, ভালো ও সুসম্পর্ক চাই। এই সম্পর্ক অন্তরের চেয়ে স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের সম্পর্ক স্বার্থের মধ্য দিয়েই দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে পরস্পরের স্বার্থেই শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকটি আলোচনার জন্য একটা যথার্থ ফোরাম। দুই দেশের মধ্যে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনায় বসাটা জরুরি। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অস্বাভাবিক যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা স্বাভাবিক করার স্বার্থে বৈঠকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত ১৫ বছরের দুই দেশের সম্পর্কের সমীকরণকে একপক্ষীয় বলে মনে করে বাংলাদেশের জনগণ। জনপরিসরে এ আলোচনা বেড়েছে। তাই ভারতের উচিত, বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষাকে অনুধাবন করে পরিবর্তিত সময়ের নিরিখে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ঘাটতি দূর করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সুযোগ রয়েছে পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে।