দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ধীরে ধীরে গতি ফিরছে। এর মধ্যে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অর্থনীতির কয়েকটি সূচকে ইতিবাচক ধারায় চলে এসেছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এর পরেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে রপ্তানি আয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিও ওঠা-নামার মধ্যে রয়েছে। তবে সামনের দিনে কমবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। পাশাপাশি অস্থির ডলারের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও কমার দিকে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের নাজুক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বস্তির দিকে আসছে। তবে নিত্যপণ্যের বাজারে এখনো অস্বস্তি চলমান। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেসামাল কাঁচাবাজার। দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা নিম্ন আয়ের মানুষ। পিয়াজ থেকে শুরু করে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, আলু কিনতে ভোক্তাকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৬টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কর কমানো সহ বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবুও সুফল আসেনি। তবে শীত মৌসুম শুরু হওয়া সবজির বাজারে ধীরে ধীরে দাম কমে আসছে।
রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন: অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবর মাসেও বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয় বাড়ছে: গত ৯ই অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে চার মাসের তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ১৩৭ কোটি (১১.৩৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই আয়ের অঙ্ক ছিল ১ হাজার ৮২ কোটি ডলার।
রিজার্ভ: এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) ১৫০ কোটি ডলার পরিশোধের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আইএমএফ’র বিপিএম-৬ মানদণ্ড অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৮.১৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের কারণে গত ৭ই নভেম্বর সাময়িকভাবে ২০ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে দেশের রিজার্ভ। তবে গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করছে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেয়ার পর বলেছিলেন, বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। আমাদের লক্ষ্য হবে অর্থনীতিকে যত দ্রুত সম্ভব গতিশীল করা। সমপ্রতি অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেছেন, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে।’
বাজারে অস্বস্তি: বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু এখনো ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলুর পাশাপাশি বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও বাড়তি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা ও খোলা পাম তেল ১৬২-১৬৩ টাকায় বিক্রি হয়। এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৬-১৭ টাকা ও খোলা পাম তেলের দাম ১৩ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহে কিছুটা সংকট ছিল। মঙ্গলবার ভোজ্য তেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর ৫ শতাংশ কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে।
সূত্রমতে, আলু আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নির্ধারণের পাশাপাশি বিদ্যমান ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করেছে সরকার। পিয়াজ আমদানিতে মোট কর ১০ শতাংশ পুরোটাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। চাল আমদানিতে বড় ছাড় দেয়া হয়েছে। আমদানিতে ৬২.৫০ শতাংশ শুল্ককর থেকে শুধু ২ শতাংশ অগ্রিম কর রেখে বাকিটা প্রত্যাহার করা হয়। এতে আমদানি পর্যায়ে কেজিতে দাম ১৪ টাকা ৪০ পয়সা কমার কথা। ডিমের শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি ডজনে দাম কমার কথা ১৩ টাকা ৮০ পয়সা। পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল সরবরাহের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল এবং পরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ১৫ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনিতেও দেয়া হয়েছে বড় ছাড়। অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। অর্থাৎ প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনিতে শুল্ক কর ১১ টাকা ১৮ পয়সা এবং পরিশোধিত চিনিতে ১৪ টাকা ২৬ পয়সা কমানো হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় দফায় পরিশোধিত চিনি আমদানিতে নির্ধারিত শুল্ক ১ হাজার ৫০০ টাকা কমানো হয়।
এদিকে বাজারে বেশ কিছুদিন চড়া দাম থাকার পর চলতি সপ্তাহে পিয়াজের দাম কমেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমেছে। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ১২০-১৩০ টাকা ও আমদানি করা পিয়াজ ১০০-১০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এ ছাড়া শীতের সবজির সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দামও পড়তির দিকে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজারে শীতের সবজির সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দামও কমতে শুরু করেছে। তিন সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি শিম ২৩০-২৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এখন দাম কমে ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৫০-৬০ টাকা, প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১৪০-১৬০ টাকা, মুলা ৫০-৬০ টাকা, শালগম ১০০ টাকা, বেগুন ৮০-১২০ টাকা, পেঁপে ৪০-৫০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৭০-৮০ টাকা ও লাউ ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য সবজি ও শাক আগের দামে স্থিতিশীল রয়েছে।
বাজারে ব্রয়লার মুরগি বেশ কিছুদিন ধরেই ১৯০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়েছে সোনালি মুরগির দাম। এ ছাড়া ফার্মের মুরগির ডিমের দামও আগের সপ্তাহের মতো প্রতি ডজন ১৪৫-১৫০ টাকায় অপরিবর্তিত ছিল।