আধুনিক বিশ্বকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব মনে করা হয়। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানেরও অন্যতম মূলনীতি। গণতন্ত্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যম। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও আমাদের দেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ফলে গণতন্ত্রও বিকশিত হতে পারেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অবস্থার বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন আইনী মারপ্যাঁচে দেশের গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত করার অভিযোগ উঠেছে জোরালোভাবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রায় সব সূচকেই পরিস্থিতির উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। যা স্বাধীন ও সভ্য দেশে কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। জানা গেছে, বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ আগের সূচকের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে। চলতি বছরের ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৪ সালের এই সূচক প্রকাশ করেছে। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম, স্কোর ২৭ দশমিক ৬৪। ২০২৩ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৩তম। স্কোর ছিল ৩৫ দশমিক ৩১।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের বড় অবনমন ঘটেছিল ২০২২ সালে। ২০২১ সালের তুলনায় ওই বছর সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল। পরের বছর আরও এক ধাপ পেছায় বাংলাদেশ। এবার দুই ধাপ পিছিয়েছে। সে হিসেবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে তিন বছরে সূচকে বাংলাদেশের ১৩ ধাপ অবনমন ঘটল, ১৫২তম থেকে ১৬৫তম অবস্থানে নেমে গেল বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। গত বছরের তুলনায় সামাজিক ও নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও বাকি তিনটি ক্ষেত্রে অবনমন হয়েছে। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার আলোচনায় আরএসএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি নাগরিকের মধ্যে এক পঞ্চমাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের সংযোগ সামান্য। সংবাদ ও তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা বাড়ছে।
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতার সরকারি প্রচার-প্রচাণার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ভূমিকাও একই। ব্যক্তিগত মালিকানায় তিন হাজার প্রিন্ট মিডিয়া (দৈনিক ও সাময়িকী), ৩০টি রেডিও স্টেশন, ৩০টি টিভি চ্যানেল ও কয়েকশ নিউজ সাইট রয়েছে। এর মধ্যে সরকারপন্থী সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল সময় টিভি ও একাত্তর টিভি খুব জনপ্রিয়। স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চলা বা বিরোধীদের মালিকানায় কোনো টিভি চ্যানেল নেই। দেশটির শীর্ষস্থানীয় দুটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি মেনে চলে।
আরএসএফের ভাষ্যমতে, তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা পছন্দ না হলে সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলা চালিয়ে এসেছে। কোনো সাংবাদিককে চুপ করিয়ে দিতে বা সংবাদমাধ্যমকে বন্ধ করতে বিচারিক হয়রানি করা হয়েছে। এ ধরনের বৈরী পরিস্থিতিতে সরকারি ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে এমন বিষয় সম্পাদকেরা সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যান।
সে সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) করা হয়েছে, তারও সমালোচনা করেছে আরএসএফ। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমের বেশির ভাগই হয়েছে এদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করা বড় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তাঁরা নিজেদের সংবাদমাধ্যমকে দেখেন প্রভাব বিস্তার ও মুনাফা তৈরির একটি হাতিয়ার হিসেবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখার চেয়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। গতবারের মতো এবারের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে সবার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। স্কোর ৯১ দশমিক ৮৯। নরওয়ের পরে রয়েছে ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও ফিনল্যান্ড। সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া (১৮০তম)। দেশটির স্কোর ১৬ দশমিক ৬৮। সূচকে খারাপের দিক দিয়ে দ্বিতীয় সিরিয়া (১৭৯তম), তৃতীয় আফগানিস্তান (১৭৮তম), চতুর্থ উত্তর কোরিয়া (১৭৭তম), পঞ্চম ইরান (১৭৬তম)।
এবারের সূচকে ভারতের দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। ১৫৯তম অবস্থানে আছে দেশটি। পাকিস্তান আছে ১৫২তম অবস্থানে, গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ অবনমন হয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ১৫০তম, মালদ্বীপ ১০৬তম, ভুটান ১৪৭তম ও নেপাল ৭৪তম অবস্থানে রয়েছে। সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৫৫তম, রাশিয়ার ১৬২তম এবং চীনের অবস্থান ১৭২তম।
জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের গণমাধ্যম অতীতে যেমন শৃঙ্খলমুক্ত ছিল না; এখনও নয়। সে ধারাবাহিকতায় অতীতে The Newspaper (Announcment Of declaration) Act-1975 এর মাধ্যমে মাত্র ৪ টি রাষ্ট্রায়ত্ত পত্রিকা রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল। যা কারো অজানা নয়।
অবশ্য ৯০’র গণঅভ্যুত্থানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণমাধ্যম কর্মীদের অব্যাহত দাবির মুখে আন্দোলনরত রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা অনুযায়ি জরুরি ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ সংশোধন ও ১৬, ১৭ ও ১৮ ধারাসমূহ বাদ দিয়ে অধ্যাদেশ জারী করেছিল। তবে পরবর্তীতে সে অবস্থার বিচ্যুতি ঘটানো হয়েছে। ফলে গৃহীত আইনগুলোর মৌলিকত্ব আর টিকে থাকেনি। আর বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সাল থেকে হলেও এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৩ এর খসড়া প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ সর্বসাধারণের মতামত প্রদানের সুযোগ দেওয়ায় একটা নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। কারণ, তদানীন্তন সরকার যে বিষয়েই বিধিপ্রণয়ন করছে বা করেছে তা তাদের অনুকূলেই করা হচ্ছে। এই সঙ্কীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা কোনভাবেই সম্ভব হয়নি। সকল ক্ষেত্রেই দেশ, জাতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে বা থাকছে।
মূলত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হওয়ায় আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথচলাও মসৃণ হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। অভিযোগ উঠে, শুধুমাত্র ভিন্নমতের কারণে গত ১২ বছরে প্রায় ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। একই কারণে ৩৫ লাখ মানুষকে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়েছে। মামলা দেয়া হয়েছে এক লাখ আট হাজার চৌদ্দটি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার ১ হাজার ৮২৬ জন। গুম হয়েছেন ৭৮১ জন। বিরোধীদলগুলোর পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে এমন অভিযোগ করা হলেও পতিত সরকার সরকার তার এই দাবি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের দেশে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তা রুশোর কথায় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ফরাসি দার্শনিক রুশো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলতে রাজী হননি। তার ভাষায়, জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন নিজেদের স্বার্থে। তিনি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন, যাতে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। পক্ষান্তরে প্লেটো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সবচেয়ে অযোগ্য শাসনব্যবস্থা মনে করতেন। তার মতে, যেহেতু গণতন্ত্র বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সেহেতু গণতন্ত্র কখনই উন্নতমানের শাসনব্যবস্থা হতে পারে না। কারণ প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্রেই বিজ্ঞানী, সুপন্ডিত এবং যোগ্য লোকের তুলনায় অযোগ্য অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ লোকের সংখ্যাই বেশি। তাই বেশিরভাগ লোকের শাসন অর্থই অযোগ্য লোকের শাসন। গণতন্ত্র সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণে নয়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে এসব কথা শ্রুতিকটু মনে হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা একেবারে উপেক্ষা করার মত নয় বরং অনেকটাই বাস্তবসম্মতই ছিল।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও উদার গণতন্ত্র চর্চার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আমরা মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরও এখনো আমাদেরকে গণতন্ত্র ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর উপাসনার স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ার কথা থাকলেও এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন নিতান্তই গৌণ। মূলত শাসনকাজে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা না গেলে সে সমাজ আর গণতান্ত্রিক থাকে না। এক্ষেত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেস’ বেশ প্রাসঙ্গিক। তার ভাষায়, ‘গণতন্ত্র জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’
আমাদের দেশের প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণের শাসনের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগটা দীর্ঘদিনের। নিকট অতীতে জনগণের অধিকার শুধু ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থারও গুরুতর অবনতি ঘটেছে। জনগণের ভোট দেয়ার অধিকারটাও কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ পতিত আওয়ামী লীগ বাকশালীদের বিরুদ্ধে। যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বেশ বাজারও পেয়েছে। তাই এই অশুভ বৃত্ত ভাঙার জন্য জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা দেখা দেয়। আর আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা এক অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
মানবসভ্যতায় গণতন্ত্রের ইতিহাস অতিপ্রাচীন। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে গণতন্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল ক্ষুদ্রায়তন এবং স্বল্প জনসংখ্যার। সে কারণে সভা-সমিতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের মতামত নেয়া সম্ভব ছিল। এটাই ছিল প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রাজ্যসমূহের আয়তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলোর বিশাল আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার কারণে সকল জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্ভব নয়। কাজেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের হয়ে, জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তারা নির্বাচিত হয়ে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে আশা করা হয়। এটাকে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এর প্রতিফলনটা খুবই গৌণ। সঙ্গত কারণেই সুশাসন আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। ফলে অমাদের স্বাধীনতার সুফলও অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে অধরায় রয়ে গেছে।
মূলত, আমাদের রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে বেশ আগেই। সদ্য পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি জনগণের কল্যাণে কাজ করার পরিবর্তে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকেছে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি নিয়ে । মূলত দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অনুপস্থিতির কারণেই রাষ্ট্রের কোন ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নেই। শৃঙ্খলিত গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনার অভাবেই এসব ক্ষেত্রে কোন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সুশাসনের আশাবাদটা আজও আমাদের কাছে অধরায় থেকে গেছে।
অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত শাসনব্যবস্থা। কারণ, এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ থাকে। ফলে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এটিই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। ভোটের মাধ্যমে জনগণ মতপ্রকাশের বা সঠিক রায় প্রদানে ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমরা এখন ভোট দানের অধিকার শুধু নয় বরং স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারও হারিয়েছি। অনাকাক্সিক্ষতভাবে গণমাধ্যমগুলোকে ফরমায়েসি বা আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মহড়াও প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজ-রাষ্ট্রের দর্পণ। তাই গণতন্ত্রকে সার্থক ও সফল করতে হলে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
এ বিষয়ে নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি বক্তব্য বেশ চমকপ্রদ। তিনি ২০০৪ সালে বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে লিখিত `What's the Point of Press Freedom?প্রবন্ধে ইংরেজ শাসনের শেষের দিকে ১৯৪৩ সালে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অনুপস্থিতিকেই দায়ী করেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর অপ্রয়োজনীয় আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় ব্রিটেনের তৎকালীন পার্লামেন্ট ভারতের প্রকৃত সমস্যার কথা জানতে পারেনি। ফলে শাসকগোষ্ঠী দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে সম্ভব হয়নি।
গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম সম্পর্কে আমেরিকার ফেডারেল কোর্টের বিচারপতি রবার্ট এইচ জ্যাকসনের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষায়, ‘নাগরিকদের ভুল করা থেকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব নয়; বরং নাগরিকদের দায়িত্ব হলো সরকারকে ভুল করা থেকে রক্ষা করা।’ মূলত নাগরিক জীবনের সমস্যা, সম্ভবনা ও মতামতের প্রতিফলনের উল্লেখযোগ্য অনুসঙ্গ হচ্ছে গণমাধ্যম। তাই গণতন্ত্রকে অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত তাগিদ অনুভূত হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। বিশেষ করে আগস্ট বিপ্লবের পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। দেশ ও জাতির দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণে গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তনিষ্ঠ করতে সিনিয়র সাংবাদিক কামাল আহমেদকে প্রধান করে ১১ সদস্যের এই কমিশনের সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়েছে। সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, কমিশন অবিলম্বে তাদের কাজ শুরু করবে এবং সংশ্লিষ্ট সবার মতামত বিবেচনা করে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে। যা বর্তমান সরকারের একটি ইতিবাচক অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ।
গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। আর পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। কোন সমাজে ভিন্নমতের অনুশীলন ও চর্চা না থাকলে সে সমাজকে সভ্য বা গণতান্ত্রিক বলা যায় না। রাষ্ট্রের সকল শ্রেণি, পেশা, দলমত ও সকল ধর্মের অনুসারীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শনও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত। দার্শনিক ভলতেয়ায়ের ভাষায়, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আমি জীবন দিতেও কুন্ঠিত নই’। মূলত এটিই গণতন্ত্র ও সভ্যতার মানদণ্ড। পরমত সহিষ্ণুতা গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ; একটি অন্যটির পরিপূরক। স্বাধীন গণমাধ্যম এক্ষেত্রে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তাই বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করে গণমাধ্যমকে গণমুখী করে তুলবে বলেই জনগণের প্রত্যাশা।