১৭ অক্টোবর ২০২০, শনিবার, ১:৪৬

শ্লীলতাহানির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : ক্লাস টু-থ্রির একটি মেয়ে স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি শুনেছে। এটা নাকি খুব খারাপ কাজ। কিন্তু কাজটা কী রকম তা মেয়েটি জানে না। বোঝেও না। তাই একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করে বসে, “বাবা ধর্ষণ কী রকম খারাপ কাজ?”

মেয়ের প্রশ্ন শুনে তো বাবার চোখ ছানাবড়া! কী জবাব দেবেন এর। শেষমেশ বাবা বুদ্ধি করে মেয়েকে বলেন, “এটা তেমন কিছু না মা, বন্ধুদের মধ্যে একরকম মারামারি বা ঝগড়া আর কী।”

বাবার জবাব শুনে অনুসন্ধিৎসু মেয়ে সেদিন থেমে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু বাবাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে হলো আরেকদিন, যেদিন মেয়েটি বাবাকে এসে নালিশ জানালো যে, স্কুল থেকে আসবার পথে দুটো ছেলে তাকে ‘ধর্ষণ’ করেছে।
বাবার বুঝতে অসুবিধে হলো না ঘটনা। মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি স্কুলে গিয়ে কাল তোমার স্যারের কাছে বিচার দেবো।”

মেয়ে চেচিয়ে উঠলো, “না বাবা, আমিও ওদের আচ্ছা করে ধর্ষণ করে দেবো কিন্তু।”
বাবা মেয়ের কথায় বিব্রত বোধ করেন এবং ধমকের সুরে বলেন, “ঠিক আছে মা, তুমি থামোতো, কাল আমি স্কুলে গিয়ে তোমার স্যারের কাছে নালিশ করবো। স্যার ঠিক বিচার করবেন।”

পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে ‘ধর্ষণ’ শব্দের সঙ্গে এতো ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষ পরিচিত ছিল না। ঘটনা ঘটলেও এতোটা বহুলভাবে ঘটতো না। কালেভদ্রে কোথাও এমন ঘটনা ঘটলে তা প্রায়শ চেপে যাওয়া হতো।

আর ‘ধর্ষণ’ শব্দও সরাসরি বলা হতো না। শ্লীলতাহানি, সম্ভ্রমহানি, বেইজ্জতি, অসম্মান, কুকাম ইত্যাদি বলা হতো। এখন কোনও রাখঢাক নেই। সরাসরি ‘ধর্ষণ’ই বলা হয়। প্রিন্ট মিডিয়া, টেলিভিশন, ফেসবুক সবখানে সরাসরি ‘ধর্ষণ’ চালিয়ে দেয়া হয়। এমনকি বাসাবাড়িতেও সবার সামনে সবাই ‘ধর্ষণ’ শব্দের সাবলীল ব্যবহার করেন। কারুর কাছে কোনও আড়ষ্টতা নেই। জড়তা বা ইতস্ততভাব নেই। মনে হয়, ধর্ষণের মতো অপকর্মটি কোনও স্বাভাবিক এবং সাধারণ ঘটনা।

ধর্ষণ বা নারীর শ্লীলতাহানি কোথায় হচ্ছে না? স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মক্তব, ভার্সিটি, মাঠঘাট, ছাত্রাবাস সর্বত্র ধর্ষণের সয়লাব। অসহায় গৃহকর্মীর ওপরেও ঝাঁপিয়ে পড়ছে গৃহকর্তা কিংবা বাড়ির ছেলেটি। এমনকি বিদেশে গিয়েও বাঙালি মেয়েরা শেখ কিংবা তাদের ছেলেদের হাতে ইজ্জত-সম্ভ্রম খুইয়ে দেশে ফিরছে। কেউ কেউ জীবনও বিসর্জন করছে। তবে যেসব মেয়ে বিদেশে গিয়ে শেখদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে তাদের এমন দুর্ভাগ্য ছাড়া আর ভালো কী আশা করা যায়, আমার জানা নেই।

সম্প্রতি আমাদের দেশে নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষত নোয়াখালির বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে সম্ভ্রমহানি, সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা দুটো দেশময় উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিনই দেশের প্রায় সর্বত্র নারীর শ্লীলতাহানির বর্বর ঘটনা ঘটে চলেছে। গৃহবধূ, শিশু, ছাত্রী, শিক্ষিকা, সমাজকর্মী কেউই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে, এদেশ যেন সভ্য মানুষের নয়। হিংস্র হায়েনার থাবায় যেন আমাদের প্রিয়দেশ। কিন্তু কেন? এতো দুঃসাহসী দুর্বৃত্তরা কীভাবে হয়?

আমি যখন এ লেখা শুরু করি, তখন এক ডাক্তার মধ্যরাতে চ্যানেল আইয়ে বক্তৃতা করলেন, কোনও ধর্মেই নাকি ধর্ষণকে উৎসাহিত করা হয়নি। কিন্তু এ উপমহাদেশে এমন ধর্ম চালু আছে যেখানে ধর্ষণই মূল উপজীব্য। ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি কোনও বিষয়ই না। এমনকি বাবা নিজকন্যাকে, শ্বশুর পুত্রবধূকে, ভাই বোনকে অনায়াসে ধর্ষণ করে। এমনকি যে-নারী ও পুরুষের চরিত্র যতো বেশি খারাপ সে-নারী বা পুরুষ ততো বেশি বড় দেবতা। কাজেই মিডিয়ায় কথা বলবার সুযোগ হলেই যা তা বলে দেয়া উচিত নয়।

নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা প্রধানত দুভাবে ঘটে। এক হচ্ছে, ছেলে ও মেয়ে দুয়ের সম্মতিতে। আর দুই হচ্ছে, ছেলে জোর করে মেয়েকে ধর্ষণ করে। দুটোই অপরাধ। তবে প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টি মারাত্মক। প্রথমটি দ্বিপাক্ষিক। দ্বিতীয়টি এক পাক্ষিক। কোনও ছেলে মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করলে মেয়ে নির্দোষও হতে পারে। কারণ তার শ্লীলতাহানি করা হয় জোরপূর্বক। প্রথমটা ঘটে দুজনের সম্মতিতে। তাই অপরাধ উভয়েরই। কাজেই শাস্তির মাত্রাও কম-বেশ হয়।

ইসলামী শরিয়া আইনে শাস্তি দুরকম। দোররা মারা এবং পাথর ছুঁড়ে হত্যা। অবিবাহিত হলে দোররা। বিবাহিত হলে পাথর ছুঁড়ে হত্যা। তবে শরিয়া আইন সৌদি আরবসহ দুয়েকটা দেশে চালু থাকলেও বেশিরভাগ মুসলিমদেশে উপেক্ষিত। ফলে জেনা-ব্যভিচার অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কোনও কোনও দেশে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে না। কোথাও কোথাও লঘু শাস্তি দেয়া হয়। ফলে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমাদের দেশে এর ব্যাপক বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সিলেটের এমসি কলেজ এবং নোয়াখালির বেগমগঞ্জের ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে দেশ। প্রতিদিন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল হচ্ছে। উঠছে ফাঁসির দাবিও।

যাহোক, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে গত ১২ অক্টোবর। পরের দিন আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হয়। ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণমামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করেছেন। উল্লেখ্য, যারা ধর্ষক তাদের সিংহভাগই মাদকাসক্ত। আর মাদকাসক্তদের হিতাহিত জ্ঞানই থাকে না। ওরা এমনই সম্মোহিত থাকে যে, ওই সময় মৃত্যুভয়ও পরোয়া করে না। আর কখন কাকে ধর্ষণের দায়ে ফাঁসি দেয়া হবে তাতো ওদের মনে থাকবার অবকাশই হয় না। তবে দোররা মারলে কিংবা পাথর নিক্ষেপে ধর্ষককে হত্যা করলে তা মানুষের মনে অনেক দিন জীবন্ত হয়ে থাকে। যেমন, সৌদি আরবে চোরের হাত কাটবার আইনের কথা ধরা যাক, সেখানে অনেক হাতকাটা মানুষ দেখা যাবার কথা। কিন্তু কই, আমি সেখানে ১৯৯৭ সালে দেড়মাস থেকে এসেছি। একজন লোকেরও হাতকাটা দেখলাম না। এর কারণ হচ্ছে, হাতকাটা যাবার ভয়ে সেখানে কেউ আর চুরির কথা চিন্তাও করে না। আর চুরির দায়ে কারুর হাতকাটা গেলেও তা খুবই নগণ্য।

একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ওপর চড়াও হয়ে তার সম্ভ্রম লুটে নেবে এমনটা সভ্য সমাজে ভাবাও যায় না। সত্যি বলতে কী পশুদের মধ্যেও এমন অমানবিক প্রবণতা নেই। অপ্রাপ্ত বয়স্ক পশুর ওপর কোনও পশু চড়াও হতে দেখা যায় না। অথচ মানুষ এমনই বিবেকহীন হয়ে পড়েছে যে, ৪-৫ বছর বয়সী মেয়েশিশুর মাতৃদ্বার ব্লেড দিয়ে কেটে তাকে বলাৎকার করছে। সৃষ্টির সেরা মানুষ কোথায় গিয়ে নেমেছে ভাবা যায়!

নারীর শ্লীলতাহানির মতো নিকৃষ্টতম অপরাধের শাস্তি কার্যকর হোক এটা সব বিবেকবান মানুষের দাবি। এখানে ধর্ষণের শরিয়া আইন উপেক্ষিত হলেও সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে। সাজা কার্যকরের সময়সীমাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আগামী সংসদ অধিবেশনে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন’ আইনের সংশোধনীটি বিল আকারে উপস্থাপন করা হবে। হবে পাসও।

ক্ষমতাধররা অপরাধ করে বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর গলিয়ে বেঁচে যাবার চেষ্টা করে। বেঁচে যায়ও। আমরা মনে করতে চাই, এবার ধর্ষকরা অপরাধ করে বেঁচে যেতে পারবে না। নতুন আইনে ধর্ষকদের যথাযথ বিচার হবে। দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অভিশাপ থেকে দেশ এবং জাতি অনেকটা নির্ভার হবে।

https://dailysangram.com/post/430916