১৫ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:২২

সামাজিক গণমাধ্যমে তথ্যপ্রবাহ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক

সামাজিক গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের মধ্যে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে একটি মহল অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

অন্য দিকে বিশিষ্টজনরা যেকোনো মাধ্যমের তথ্যপ্রবাহ বস্তুনিষ্ঠ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করলেও বলেছেন যে, আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যাদের হাতে তাদের বক্তব্য না দিয়ে বাস্তবে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। আর কোনোভাবেই সে ব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়।

গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমরা প্রেস রিলিজটি দিয়েছি সেখানে বলা হয়েছে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ানোর জন্য অনেক সময় অনেক তথ্য এসেছে, যার সত্যতায় ঘাটতি রয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে বিভিন্ন মিথ্যা খবর প্রচারিত হচ্ছে। পাশাপাশি আদালতের রায় নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন কায়দায় একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য এসব মিথ্যা অসত্য প্রচার করা হচ্ছে। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যও আমাদের নিয়মিত বাহিনীগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য অসত্য তথ্য দিয়ে অন্য ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে এই কাজ করা হচ্ছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তা রোধে কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে বা সরকারের কার্যকর কী পদক্ষেপ রয়েছেÑ জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের এনটিএমসি (জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র) একটি বিভাগ রয়েছে, তারা সবসময় মনিটর করছে। কে করছে, কোথা থেকে আসছে- আমরা সেই জায়গাটিতে কাজ করছি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ফেসবুকসহ অন্যান্য যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে তাদের সাথে আমরা আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছি। আমরা যে অভিযোগ করছি তারা সেগুলোর তথ্য আমাদের দিচ্ছে।

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পিবিআই সুন্দর তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন আসাদুজ্জামান খান কামাল।

সিলেট ও নবাবগঞ্জে পুলিশ হেফাজতে আসামির মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে তাদের হত্যা করা হয়েছে। সিলেটে পুলিশ ফাঁড়ির ঘটনার পর উপপরিদর্শক (এসআই) পলাতক রয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিলেটের ঘটনাটি তদন্তের মধ্যে রয়েছে, সেখানে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। কোতোয়ালি থানার কাস্টগড় এলাকা থেকে রায়হানকে ধরে আনা হয়েছিল। তিনি ৬টার দিকে হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতাল তাকে মৃত ঘোষণা করে। হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত হচ্ছে কিংবা হবে। সে অনুযায়ী এবং নিহত যুবকের স্ত্রী যে মামলা করেছেন তার সবগুলো আমলে নিয়ে এটার সুষ্ঠু তদন্ত হবে। তদন্ত অনুযায়ী যে দায়ী তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।

সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে কারো যেন মৌলিক অধিকার হরণ না হয়। অধিকার ক্ষুণœ না হয়। কারণ এ বিষয়ে অনেকগুলো আইন ইতোমধ্যে আছে। কিন্তু সেগুলো ভিন্নভাবে ব্যবহার করারও নজির আছে। তাই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার।

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনেক দায়িত্বশীল পদ। রাষ্ট্রের যেকোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষমতা তার রয়েছে। তার বক্তব্যের চেয়ে তার অ্যাকশন মানুষ বেশি দেখতে চায়। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ধরনের বক্তব্যে দেশ জাতি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি যদি মনে করেন, বিএনপি বা অন্যান্য দল বা গোষ্ঠী সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তাহলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।

জনাব রনি আরো বলেন, যদি এমন হয় মন্ত্রী শুধু বলছেন কিন্তু বাস্তবায়ন করছেন না তাহলে এটার নেতিবাচক দিক রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন তাহলে যারা এগুলো করছে তারা আরো উৎসাহিত হবে। যে অপকর্মগুলো হচ্ছে তার সমাধান হবে না, ফলে দুর্ভোগ বাড়বে, এর ভয়াবহতা আরো বৃদ্ধি পাবে। কারণ তারা মনে করছে, এটা শুধু কথার কথা, কোনো ব্যবস্থাতো নিচ্ছে না।

জনাব রনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত হবে, এ ধরনের কোনো বক্তব্য না দিয়ে যে বা যারা এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া উচিত, সে যেই হোক না কেন।

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কখনোই নেতিবাচক ধারণা দেয়া ঠিক নয়। যে পক্ষই হোক না কেন, যে পক্ষই দিক না কেন, ভুল বা অসত্য তথ্য দেয়া ঠিক নয়, এটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন বেশ জনপ্রিয় এবং সবাই এটা ব্যবহার করে। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোনো ব্যক্তি, কোনো গোষ্ঠী, কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে তাহলে সামগ্রিকভাবে একটা জাতির জন্য তা খারাপ। এই বিষয়টা খেয়াল রেখেই আমাদের কোনো বিষয় শেয়ার করা, মন্তব্য করা এবং পোস্ট করা উচিত।

বিশিষ্ট সংবিধান ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ড. ইকতেদার আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে কেউ যখন কোনো তথ্য দেবে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ হওয়া উচিত। বস্তুনিষ্ঠ না হলে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। আর এই তথ্য বিভ্রান্তির মাধ্যমে যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এটা পরিহার করা উচিত। তিনি বলেন, উসকানিমূলক কোনো তথ্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া ঠিক নয় বলে আমি মনে করি। এতে সমাজ বা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এসব কার্যক্রম এড়িয়ে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রদান করলে মানুষ উপকৃত হয়, সঠিক বিষয়টা মানুষ জানতে পারে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, পিবিআই-কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যাতে পিবিআই একটা সুন্দর তদন্তের মাধ্যমে সিলেটের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারে। আর নবাবগঞ্জের ঘটনাটা হলো হাজতখানায় একজন আসামি বাথরুমে গিয়ে নিজের লুঙ্গি দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাও আমরা ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তের মাধ্যমে দেখব। হাজতখানার ভিতরে কিভাবে তিনি মারা গেলেন, সেটাও আমাদের দেখার বিষয়। কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন, তাকে কেউ প্ররোচনা দিয়েছিল কি না, সব বিষয়ই আমরা দেখব।

নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্যক্রম শেষ হয় না, এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সবশেষ কেবিনেট বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নারী নির্যাতন আইনে আরো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি। নারী নির্যাতনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশের জন্য অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে, কয়েকটি ঘটনা সবার চোখে পড়েছে। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত এসেছে।

তিনি বলেন, বিচারের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নয়। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার সুষ্ঠু হওয়ার জন্য যা করা প্রয়োজন করছি। পুলিশি তদন্তসহ সব বিষয়ে নজর রাখছি। প্রয়োজনে পিবিআই-কে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তদন্ত নিরপেক্ষ করতে যা দরকার করছি, করব। বিচার আমাদের হাতে নেই, আদালত বিচারের সিদ্ধান্ত নেবেন। তারাও দ্রুত বিচারের বিষয়টি বলেছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসিড নিক্ষেপ নিয়মিত ঘটনা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলো এবং তার কয়েকটি রায় কার্যকর হওয়ার পর এটি কমে গেছে। এখন নারী নির্যাতনের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি করা হয়েছে। আমরা আশা করি এটিও কমে যাবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/535357