১৫ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:০৮

দেশ জাতি রাষ্ট্র

এভাবে দেশ চলতে পারে না

-ড. আবদুল লতিফ মাসুম

মুখ মনের আয়না। আর সংবাদপত্র সমাজের আয়না। যেমন মুখমণ্ডলের ময়লা-মেছতা নির্দেশ করে আয়না তেমনি সংবাদপত্র সমাজের অন্যায়-অনাচার, সুকর্ম-অপকর্ম নির্দেশ করে। মহৎ জনেরা ব্যক্তিকে যখন আত্মসমালোচনার আহ্বান জানান তখন বলেন, ‘লুক ইনটু দ্য মিরর’। নিজের মনের আয়নায় নিজকে দেখতে হয়। তাহলে নিজের ভুল-ত্রুটি-বিচ্যুতি নিজের চোখেই ধরা পড়ে। দুঃখের বিষয়, জাতিগতভাবেই আমরা নিজের দোষ-ত্রুটি দেখতে অভ্যস্ত নই।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ^াস করি না; যাহা বিশ^াস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহঙ্কার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’ আজকের পরিপ্রেক্ষিতে কবিগুরুর এই উদ্ধৃতি শতভাগ প্রাসঙ্গিক।

আমরা শুধুই প্রশংসা প্রশস্তি শুনতে চাই। গঠনমূলক সমালোচনা আহ্বান করি। কিন্তু যখন সমালোচনা আসে তখন আকাশ বিদীর্ণ করি। এই স্ববিরোধিতা নিয়েই আমাদের বসবাস। যে সংবাদপত্রকে ‘সমাজের আয়না’ বলছি সেখানও স্ববিরোধিতার অন্ত নেই। এই মুহূর্তে যে লজ্জাকর পরিস্থিতি জাতি অতিক্রম করছে তার সতত প্রকাশেও কোনো কোনো সংবাদপত্র দ্বিধান্বিত। কিন্তু তারপরও সামগ্রিক প্রকাশ সাহসেরই। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সেন্সরকে উপেক্ষা করে সমাজের আয়না হয়ে উঠার প্রয়াস প্রশংসনীয়।

একদিন প্রতিদিন : দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের যে ছবি-প্রতিচ্ছবি সংবাদপত্রের আয়নায় প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন, তা নাগরিক হৃদয়কে বিচলিত না করে পারে না। বিষয়টি প্রামাণ্য করার জন্য প্রতীকী অর্থে পাঁচটি সংবাদপত্রের প্রতিচ্ছবি নিয়ে এই লেখা তৈরি করছি। এই পাঁচটি সংবাদপত্র হচ্ছেÑ ইত্তেফাক, প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, বণিক বার্তা এবং নিউ এজ। বছর-মাস-পক্ষ এমনকি সপ্তাহের সমীক্ষা নিলেও ভারী হয়ে যাবে এই প্রতিবেদন। তাই এক দিনের হিসাব-নিকাশই নিতে চাই। গত সোমবার, ১২ অক্টোবর ২০২০ কে নির্দিষ্ট করে এ সমীক্ষা শুরু করছি।

ইত্তেফাক : এদিন ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘মাদকেই সর্বনাশ’। উপ-শিরোনামে বলা হয়Ñ স্থানীয় নেতা ও প্রশাসনের সহায়তায় চলছে সেবন ও বিক্রি। মাদকের টাকায় বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন বাহিনী। ধর্ষকদের বিচার দাবিতে শাপলা চত্বরে অবরোধের পাশাপাশি ধর্ষণের খবরও ছিল। শেষ পৃষ্ঠায় দু’টো খবর : সম্ভ্রম রক্ষায় অটোরিকশা থেকে লাফিয়ে পড়ল ছাত্রী, আরো সাত নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার, বলাৎকারের ঘটনায় আইনজীবী গ্রেফতার। ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় আরো ধর্ষণের খবর আছে : পটিয়ায় নববধূকে গণধর্ষণ, আরো আছে বরিশালের চার শিশুর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার ফলোআপ। সপ্তম পৃষ্ঠায় আছে : সাদুল্লøাপুরে ধর্ষণের চেষ্টা ও উত্ত্যক্তের দায়ে দুই যুবক আটক। একই পৃষ্ঠায় ধর্ষণের আরো খবরÑ বদরগঞ্জে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ মামলায় যুবক গ্রেফতার।

প্রথম আলো : গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে ‘নোয়াখালীর সেই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন মামলার ফলোআপ রিপোর্ট। অস্ত্রসহ ধরা, গণপিটুনি তবুও ছাড়া পাননি দেলোয়ার। তৃতীয় পৃষ্ঠার খবরÑ আইনজীবীর সাথে সাক্ষাতের কথা বলে নিয়ে ধর্ষণ। চতুর্থ পৃষ্ঠায় আছেÑ ম্যাজিস্ট্রেটকে গালাগাল, ডিসিকে হুমকি সাংসদের। শিক্ষার খবর আছে প্রথম পাতায়Ñ ফল চূড়ান্ত করতে সাত চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষা বোর্ডগুলো।

নয়া দিগন্ত : প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিলÑ বাংলাদেশ থেকে ১০টি দেশে পাচার হচ্ছে অর্থ। নির্মম! শিরোনামে খবরÑ মাগুরায় ডোঙ্গায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে শিশুহত্যা। হত্যার আরো খবরÑ ফেনীতে প্রকৌশলীকে মেরে সেপটিক ট্যাংকে গুম। দুর্নীতির খবর অষ্টম পৃষ্ঠায়Ñ টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না দোহার ভূমি অফিসে। ১১তম পৃষ্ঠাÑ নোয়াখালীতে ব্যবসায়ী অপহরণ। শেষ পৃষ্ঠায় দু’টো খবর গুরুত্বপূর্ণÑ ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষণ মামলা; এক আসামিকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়ার অভিযোগ। অর্থনীতির খবরÑ সূচকে পতন অব্যাহত শেয়ার বাজারে।

বণিক বার্তা : যেহেতু অর্থনৈতিক বিষয়ে সংবাদপত্র, তারা স্বভাবতই অর্থনৈতিক খবরের গুরত্ব দেন। প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবরÑ পাঁচ বছর ধরে থমকে আছে প্রাইম ব্যাংক। শেষ পৃষ্ঠার খবরÑ এনবিএফআই এবং লিজিং কোম্পানি গ্রাহকের প্রয়োজনীয় তথ্য না দিয়েও অর্থ জমা রাখছে। সপ্তম পৃষ্ঠার খবরÑ ৫০ টাকায় উঠেছে আলুর দাম। দশম পৃষ্ঠার খবরÑ ভোমরা বন্দর দিয়ে কাঁচামরিচ আমদানি বেড়েছে ৪০ গুণ।

নিউ এজ : প্রধান শিরোনামে বলা হয়Ñ অ্যান্টি রেপ প্রটেস্টারস গট মোমেন্টাম, দ্বিতীয় শিরোনামÑ রেপ, সেক্সুয়াল হ্যারাসম্যান্ট অন অ্যামিড প্রটেস্ট, টু ছাত্র অধিকার পরিষদ লিডারস ‘পিকড আপ’ অ্যান্ড ওয়ান মিসিং। তৃতীয় পৃষ্ঠায়Ñ ম্যান বিটেন টু ডেথ ইনসিডেন্ট।

এই পাঁচটি সংবাদপত্রে মাত্র এক দিনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা যেমন ভয়াবহ, তেমনি লজ্জাকর। আরো রয়েছেÑ নেশার খবর। রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের খবর। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার খবর। রয়েছে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের খবর। দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতিতে কিভাবে জনগণের নাভিশ^াস উঠেছে সে খবরও আছে একদিনের হিসাব-নিকাশে। বলা বাহুল্য, এই চিত্রÑ শুধু এক দিনের নয়। প্রতিদিন একই চিত্র একই খবর প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্রে। কিন্তু তেমন কোনো প্রতিকার নেই, নেই কোনো ব্যবস্থা। সুতরাং বলা যায়, এই একদিন-প্রতিদিন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। তাদের দুঃখ-কষ্ট এবং রাগ-ক্ষোভ দেখার যেন কেউ নেই।

ধর্ষণ : দেশে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে একই দিনে ইত্তেফাকে ১২টি ধর্ষণ অথবা নারী নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোতে একটি এবং নিউ এজে দু’দিনে ১০টি ধর্ষণ ও তিনটি যৌন নিপীড়নের খবর ছাপা হয়েছে। পাঁচটি দৈনিকের বাইরেও অন্য দৈনিক বা চ্যানেলে হয়তো আরো খবর আছে। সংবেদনশীলতার কারণে সবাই জানি যে, অসংখ্য ঘটনা অপ্রকাশিতই থেকে যায়। গত কয়েক বছরে, বিগত কিছু দিনে যেভাবে মহামারী আকারে এসব ঘটনা ঘটছে তা সবাইকে আশঙ্কিত ও আতঙ্কিত করেছে। যৌন আকাক্সক্ষা মানুষের জন্য স্বাভাবিক। তা মেটানোর জন্য মানব সমাজে সুশৃঙ্খল বিয়ের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে সামাজিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে এ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা এখন বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছেÑ ভোগবাদী মূল্যবোধ, দেশজ বা গ্রামীণ সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, নৈতিক অবক্ষয়, পারিপাশির্^ক প্রদর্শনেচ্ছা ও অশালীন চলাফেরা। যে কারণটিকে তাৎক্ষণিকভাবে সবাই গুরুত্ব দিচ্ছেন তা রাজনৈতিক। সবাই একমত যে, রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে এটি মহামারীর আকার ধারণ করেছে। প্রধানত বাম বুদ্ধিজীবীরা ধর্ষণকে কোনো নৈতিক সমস্যা মনে করেন না। তত্ত্বকথা দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চান, বিষয়টি রাজনৈতিক। অপরদিকে ডানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা একে নৈতিক বিপর্যয় বলে ব্যাখ্যা করছেন। উভয় বক্তব্যেই বাস্তব সত্যের প্রমাণ আছে। বিষয়টি সিনথেসিস করলে এ রকম দাঁড়ায়Ñ নৈতিক বিপর্যয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় আশকারা পেয়েছে। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, প্রকাশিত প্রতিটি ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক উপস্থাপিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের স্পষ্ট অভিমতÑ ‘রাজনীতি ঠিক করুন, আইন কাজ করবে’।

নেশা : ধর্ষণই একমাত্র সমস্যা নয়। এক দিনের সংবাদপত্রে আরো যেসব সর্বনাশের বর্ণনা রয়েছে তার মধ্যে নেশা একটি। গোটা জাতিকে ক্রমশ মাদকদ্রব্য আচ্ছন্ন করে ফেলছে। যুবসমাজ ভয়ানকভাবে নেশায় আক্রান্ত। সরকার প্রতিকার হিসেবে শক্তি প্রয়োগের কৌশল ধরেছে। মাঝখানে প্রানহানি ঘটেছে কিছু মানুষের যাদের অপরাধ যথার্থভাবে প্রমাণিত হয়নি। এই সর্বনাশা নেশার প্রসারের ক্ষেত্রেও দায়ী ক্ষমতাসীন মহল। ইত্তেফাকের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সারা দেশে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সহায়তায় চলছে মাদক সেবন ও বিক্রি। মাদকের টাকায় বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে কিশোর গ্যাং।’ এরা ধর্ষণই শুধু করে না; চাঁদাবাজি, খুন, জমি দখলসহ নানা অপরাধে জড়িত। সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ মাদকসক্তি। আর মদদের জন্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রকট।

রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য : প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারকে ‘দাঁত ভাঙা’ জবাব দেয়ার হুমকি দিয়েছেন স্বতন্ত্র এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন। তিনি চরভদ্রাসনের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ফোন করে গালিগালাজ করেছেন। ভাঙ্গা উপজেলার ‘সহকারী কমিশনার ভূমি’ এসব গালাগালির লক্ষ্য। চরভদ্রাসন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে। এই দুই ঘটনার ভিডিও ও অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠনের ফরিদপুর শাখা এর প্রতিকার চেয়েছে। এই আচরণ অস্বাভাবিক হলেও বিরল নয়। সংবাদপত্রে প্রায়ই শাসকদলীয় কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা প্রশাসনকে এভাবে অপমান ও অপদস্থ করার ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। নিক্সন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে এসব আচরণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

হত্যা ও গুম : প্রতিদিন হত্যা ও গুমের খবর আসছে। ১২ অক্টোবর উল্লিখিত পাঁচটি সংবাদপত্রে কমপক্ষে পাঁচটি খুনের খবর আছে। আছে গুমের খবর। ধর্ষণবিরোধী চলমান আন্দোলনের নেতৃত্বশীল সংগঠন ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্যতম নেতা নাজমুলকে ১১ অক্টোবর দুপুরে মগবাজার এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে সংবাদপত্রে খবরে জানা গেছে। নাজমুলকে এক ধর্ষণ মামলার আসামি করা হয়েছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ওইদিন বেলা ২টা ১০ মিনিটের দিকে মগবাজারের মডার্ন হারবালের অফিস থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। একটি চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য নাজমুল সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। পরিবারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। রমনা থানার ওসি বিষয়টি ‘জানেন না’ বলে জানিয়েছেন।

অর্থ অব্যবস্থাপনা : শত শত কোটি কোটি টাকা অর্থ পাচারের কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশ থেকে ১০টি দেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ইত্যাদি। ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর সুইস ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশীদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪৮১ দশমিক ৩২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ৬ শ’১৭ দশমিক ৭২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে লুটপাটের ঘটনা সবারই জানা কথা। ‘বণিক বার্তা’য় প্রকাশিত প্রাইম ব্যাংকের বিষয়টিও এ রকম। দেশে বিনিয়োগ ও লিজিং কোম্পানির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রন নেই। ইতঃপূর্বে যুবক ও ডেসটিনির দ্বারা প্রতারিত হয়েছে অনেক মানুষ।

শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য : বর্তমান সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতি সাধনের রেকর্ড রয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতে দলটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরীক্ষা নেয়ার পরিবর্তে অটো পাস করিয়ে দেয়। এ সময়ে নকলের ক্ষেত্রে বিশ^রেকর্ড করার মতো ঘটনা ঘটেছিল। তাদের আমলে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও ধস নামে। ১৯৯৬ সালে তারা যখন আবার ক্ষমতাসীন হন, তখন নকলের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। আর ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে নকল প্রাইমারি থেকে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

সব পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁসের মহোৎসব ঘটে। এমনকি বিসিএসের মতো মর্যাদাপূর্ণ পরীক্ষায় একই ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে অন্যান্য চাকরির জন্য গৃহীত পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। করোনার সময়কালে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও তারা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোনো ধরনের পরীক্ষাপদ্ধতি উদ্ভাবন ও সংস্কার না করে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ভিত্তিতে দেয়ার সিদ্ধান্ত অরাজকতার সৃষ্টি করেছে। এখন শিক্ষা বোর্ডগুলো এ ধরনের রেজাল্ট সমন্বয় করতে গিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, এরা সাত ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এসএসসির পর উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ পরিবর্তন, মান উন্নয়ন পরীক্ষার্থী এবং কারিগরি থেকে সাধারণ শিক্ষায় আসা পরীক্ষার্থীসহ সাত ধরনের পরীক্ষার্থীকে নিয়েই এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

পাঁচটি দৈনিকের এক দিনের প্রতিবেদনে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে তা খুবই উদ্বেগজনক। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে যে সর্বনাশের সূচনা হয়েছে তা দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের কোনো অভিভাবক নেই, নেতৃত্ব নেই এবং নির্দেশনাও নেই। অবাধ লুটপাট ও বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলছে দেশ। এভাবে বিপর্যয়ের মুখে দেশ চলে যাবে আর তা নাগরিকরা নির্বিকারভাবে চেয়ে চেয়ে দেখবে এটা কাম্য হতে পারে না। সমাজের আদর্শিক পরিবর্তনের লক্ষ্য যদি অর্জিত হয় তাহলেই কেবল স্থায়ীভাবে এই ঘুণে ধরা সমাজের ক্যান্সারসম ব্যাধিগুলোর প্রতিকার হতে পারে। আর আপাত লক্ষ্য হিসেবে যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব অপরাধ এবং অপব্যবস্থাগুলো বিরাজিত তাদের পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তন শুধু সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্য দ্বারা অর্জিত হবে না। সমাজের খোলনলচে পাল্টে দিয়ে সামগ্রিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই মৌলিক লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ‘এই ভোগসর্বস্ব পুুঁজিবাদী সমাজের পরিবর্তন করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। এটি সবার বিষয়। এটি একটি মানবিক কর্ম। সবাই মিলেই এটি করতে হবে। সমাজ বদলের আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলতে হবে।’

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/535457