১৫ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:০৪

ঘনীভূত হচ্ছে সভ্যতার সংকট

দেশ চালানো, সরকার চালানো কি সহজ কাজ? এসব কাজের গুরুভার ও কাঠিন্য উপলব্ধি করলে কোন সুস্থ মানুষ কি হাসি মুখে ওই দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসতে পারেন? কিন্তু বর্তমান সভ্যতার চিত্র অন্য রকম। এখন তো রাজনীতিবিদরা দেশের শাসক হতে শুধু এগিয়েই আসেন না, ক্ষমতা পেতে বৈধ-অবৈধ সব কৌশল অবলম্বন করেন। আর এমন কৌশলে একবার নয়, বারবার ক্ষমতায় আসতে চান। ফলে প্রশ্ন জাগে, ক্ষমতা কার জন্য, কিসের জন্য? ভোটের বক্তৃতায় কত প্রতিশ্রুতি। এইসব প্রতিশ্রুতি পূরণ হলে তো জনগণের আনন্দের সীমা থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি আর পূরণ হয় কই। ফলে আবার নির্বাচন, আবার প্রতিশ্রুতি। এমন গোলক ধাঁধায় রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের মর্যাদা অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মানুষ এখন প্রতারক ও ঠকবাজদের লক্ষ্য করে বলে থাকেন, আমার সাথে ‘পলিটিক্স’ করতে আসবেন না।

আমাদের উপমহাদেশে রাজনীতির রূপটা একসময় বেশ উজ্জ্বল ছিল। মানুষ তখন বিশ্বাস করতো, নেতারা দেশের স্বাধীনতার জন্য, গণমানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছেন। ক্রমেই সেই বিশ্বাস দুর্বল হতে লাগলো। মানুষ এখন রাজনীতিবিদদের বক্তব্যক ‘কথামালা’ কিংবা ‘ব্লেমগেম’ হিসেবে অবজ্ঞা করে থাকে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসনের আকাক্সক্ষায় অনেকেই পাশ্চাত্যের উদাহরণ টেনে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু সেই পাশ্চাত্যের রূপটাই বা কেমন? মানুষ তো অনেক দিন ধরেই পাশ্চাত্যের দ্বৈতনীতি লক্ষ্য করে আসছে। দেশে তাদের মানবাধিকারের সংজ্ঞা এক রকম, আর বিদেশে অন্যরকম। আর তাদের মননে যে এখনো বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বহমান রয়েছে, তাতো অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রকাশিত ঘটনাবলীই তার বড় প্রমাণ। পাশ্চাত্যের মুখোশও ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়ে পড়ছে। কিছুদিন আগে আমরা বৃটেনের রাজনীতিতে টালমাটাল চিত্র লক্ষ্য করেছি, আর এখন দেখার মতো বিষয় হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি। এই রাজনীতির প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় শুরু থেকেই নানা রকম বক্তব্য প্রদান করে আসছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ডাকভোটে কারচুপি হতে পাবে। এছাড়া তিনি আরও বলেছেন, এবার নির্বাচনের ফলাফলের নিষ্পত্তি হতে পারে সুপ্রিম কোর্টে। ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে আফ্রিকা, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষক রয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড্রেন নুপেন বলেন, ট্রাম্প এখনই ভোটারদের মনে একটি সন্দেহের বীজ বপন করে দিচ্ছেন যে, এই নির্বাচন স্বচ্ছ হবে না। তিনি যদি নির্বাচনে হেরে যান, তখন ভোটারদের নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করতে পারবেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেন ওপালো আশংকা করছেন, এবার নির্বাচনের পর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন, তার একটি বক্তৃতার অংশবিশেষ প্রসঙ্গ বহির্ভূতভাবে বিজ্ঞাপনে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এটা বিভ্রান্তিকর। নির্বাচনী প্রচারণার বিজ্ঞাপনে তার বক্তব্য ব্যবহারের জন্য কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। উল্লেখ্য যে, ফাউচি হোয়াইট হাউসের করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের সদস্য। করোনা মহামারির পর তাকে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন খুব বিশ্বাস করে আসছেন। তার এই বিশ্বাসযোগ্যতাকে কাজে লাগাতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা শিবির নির্বাচন বিজ্ঞাপনে ফাউচির বক্তব্য সম্পাদনা করে ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ট্রাম্পের প্রচারণা শিবিরের একটি টিভি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, ফাউচি বলছেন- করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেউ আর বেশি কিছু করতে পারেন বলে তিনি ভাবতে পারেন না। ফাউচির এমন বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনেক কিছু করেছেন। ট্রাম্পের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে করোনা পরিস্থিতি খুব একটা বদলাতো না। অথচ করোনা মহামারিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। এ প্রসঙ্গে ফাউচি সিএনএনকে বলেছেন, প্রায় পাঁচ দশকের সরকারি চাকরি জীবনে তিনি কখনও কোন রাজনৈতিক প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানাননি। অথচ রিপাবলিকান পার্টি তার একটি বক্তব্যের অংশবিশেষ নিয়ে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার রয়েছে। প্রসঙ্গ বহির্ভূতভাবে বিজ্ঞাপনে ওই বক্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। বক্তব্য ব্যবহারের জন্য রিপাবলিকান পার্টি তার অনুমতি পর্যন্ত নেয়নি। এমন চিত্র থেকে উপলব্ধি করা যায়, নির্বাচনে জেতার উদগ্র বাসনা কোন্্ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও নীতি-নৈতিকতায় ধস নেমেছে। দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোর দিকে এখন অঙ্গুলি নির্দেশ করে আর তৃপ্তি লাভের সুযোগ নেই। নীতি-নৈতিকতার সংকট আসলে বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার সংকট।

শুরুতে বলেছিলাম, দেশ চালানো-সরকার চালানো খুব কঠিন কাজ। যারা এই দায়িত্বের কাঠিন্য উপলব্ধি করেন, তারা নিজ থেকে তা গ্রহণের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করতে পারেন না। ফলে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে কারা? ক্ষমতালোভী কিংবা স্বার্থান্ধ মানুষদের এই দায়িত্ব গ্রহণ করা সঙ্গত নয়। তবে যারা আদর্শবাদী এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন- তাদের পক্ষে এমন দায়িত্ব গ্রহণ শোভা পায়। তবে তারা কখনো দেশ পরিচালনা কিংবা ক্ষমতা লাভের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন না। সমাজ বাস্তবতায় কখনো যদি দায়িত্ব গ্রহণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়, তখন সাহসের সাথে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পলায়নবৃত্তি তাদের মননে নেই। এমন আদর্শবাদী নেতৃত্বের সংকট এখন পৃথিবীতে প্রকট। এ কারণেই সভ্যতার সংকট হচ্ছে আরো ঘনীভূত।

https://dailysangram.com/post/430664