১৩ অক্টোবর ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৪৩

মাদরাসা শিক্ষা, ষড়যন্ত্রের শেষ কোথায়?

ড. মো. নূরুল আমিন : ভারতের আসাম রাজ্যের রাজ্য সরকার রাজ্যটিতে পরিচালিত সকল মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মীয় শিক্ষা চলতে পারে না এই নীতির অধীনে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বলাবাহুল্য, ইতোপূর্বে মাদরাসা শিক্ষার উপর বিশ^ ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে সরকারকে সুপারিশ করেছিল যে, মাদরাসা শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং ধর্মীয় শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই। রাজ্য সরকার মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রধান বাহন মাদরাসা শিক্ষা বন্ধ করে দিলেও হিন্দু শিক্ষায় নিয়োজিত রাজ্যের সংস্কৃত টোলসমূহ বন্ধ করার কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এ প্রেক্ষিতে অনেকে মনে করছেন যে, ভারতের এই রাজ্যটিতে মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার জন্যই এই ব্যবস্থা গৃহিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আসাম রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ৩৫ % মুসলমান; এই রাজ্যের ১৬টি জেলার মধ্যে ৬টি জেলাতেই মুসলমানের সংখ্যা ৬৪ শতাংশের বেশি। বাকীরা প্রকৃতিবাদী ও হিন্দু। ভারত বিভাগের সময় এই রাজ্যে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু ছিল, সাত শতাংশ হিন্দুদের সংখ্যা ছিল, বাকীরা ছিলেন প্রকৃতিবাদী। এ প্রেক্ষিতে সেখানে এখনো প্রকৃতিবাদীরা সংখ্যাগুরু, হিন্দুরা সংখ্যালঘু।

আসামের শিক্ষামন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা জোর দিয়ে বলেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সরকারি তহবিল খরচ করে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া যায় না। গত মে মাসে তিনি বলেছিলেন যে, মাদরাসার পাশাপাশি হিন্দু টোলগুলোও বন্ধ করে দেয়া হবে কিন্তু সাম্প্রতিক ঘোষণায় শুধু মাদরাসাগুলোর কথাই তিনি উল্লেখ করেছেন। এর ফলে রাজ্য পরিচালিত ৬১৪টি মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু তাদের পরিচালিত শতাধিক হিন্দু টোল কাজ কর্ম অব্যাহত রাখতে পারবে। মাদরাসাগুলো পরিচালনা বাবত সরকার বছরে তিন থেকে চার কোটি এবং টোল বাবদ বছরে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় করতো। মাদরাসাগুলো আসামের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হতো। মাদরাসা বন্ধের এই সিদ্ধান্তকে আসামের মুসলিম নেতৃবৃন্দ হঠকারী আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সরকার ধর্মনিরপেক্ষ হলেও সেখানকার জনগণ ধর্মনিরপেক্ষ নয় এবং তারা তাদের ধর্মীয় শিক্ষাকে বলি দিতে পারে না। এটা করতে গেলে তাদের ধর্মীয় অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। আগেই বলেছি, মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে বিশ^ ব্যাংক ও এডিবি এর আগে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে এবং তাতে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থানও তুলে ধরা হয়েছিল। তার আলোকে ভারতের একটি রাজ্যে আজ মাদরাসা শিক্ষা বন্ধ হয়েছে, কাল আরেকটি রাজ্যে ও পরে বাংলাদেশের পালাও আসবে। এটি একটি ষড়যন্ত্র।

মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র আমাদের দেশেও নতুন নয়। ইতোপূর্বে আমি এই স্তম্ভে একাধিকবার এ নিয়ে আলোকপাত করেছিলাম। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবুল বারাকাতের প্রকাশিত একটি বই দেশের আলেমদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এই বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য মুখ্যত দায়ি। তার অভিমত অনুযায়ী মাদরাসা শিক্ষা সম্প্রসারণের কারণে অনেক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাই শুধু ধ্বংস হচ্ছে না অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। মাদরাসাকে তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন।

“পলিটিকেল ইকোনমি অব মাদরাসা এডুকেশন ইন বাংলাদেশ : জেনেসিস গ্রোথ এন্ড ইমপেক্ট” শীর্ষক এই বইটি গ্রন্থনায় আরও চারজন শিক্ষক ও গবেষক জনাব বারাকাতকে সহায়তা করেছেন বলে জানা যায়। বইতে মাদরাসাসমূহকে উগ্র জঙ্গিবাদী বিভিন্ন সংগঠন সৃষ্টি ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য দায়ি করা হয়েছে। দেশের আলেম সমাজ এর প্রতিবাদ করেছেন এবং বইটি বে-আইনি ঘোষণার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। আমার দৃষ্টিতে বারাকাতের এই বইটি দেশী-বিদেশী চক্রের মাদরাসাবিরোধী তৎপরতার একটি অংশ মাত্র। অন্যান্য তৎপরতা অক্ষুন্ন রেখে শুধুমাত্র একটি বই বাজেয়াপ্ত করলে সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য দেশের আপামর জনসাধারণ ও আলেম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ থেকে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের সামগ্রিক জীবনধারাকে ইসলাম ও তার অনুশাসন থেকে মুক্ত করার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বহুমুখী হামলা শুরু হয়েছে। প্রথম প্রথম এই হামলার রাখঢাক থাকলেও এখন আর তা নেই; প্রকাশ্যে এই হামলা শুরু হয়েছে। আবার এই হামলার কৌশলও পরিবর্তন হয়েছে। আগে বহিঃশক্তির মাধ্যমে এই হামলা হতো এবং তাতে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ এবং সংহতির ব্যাপক কোনও ক্ষতি করতে না পেরে হামলাকারী এই শত্রুরা ইসলামী উম্মাহর মধ্য থেকেই একটি গ্রুপ তৈরি করে সন্ত্রাস নৈরাজ্যের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে লাগানোর কৌশল অবলম্বন করেছে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে জেএমবিসহ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থান এবং পরবর্তীকালে দেশব্যাপী ধ্বংসাত্মক বোমাবাজিতে তাদের সম্পৃক্তি এই কৌশলেরই অংশ ছিল। দেশের বরেণ্য আলেম উলামা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী বিশেষজ্ঞরা সন্ত্রাস ও বিনা কারণে মানুষ হত্যাকে কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলামের মৌলিক আকিদা বিশ্বাসের পরিপন্থী ঘোষণা করলেও তারা ইসলামকে জঙ্গি প্রমাণের অপপ্রচার থেকে বিরত হয়নি। তবে এ ব্যাপারে তারা সাফল্য সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত হতেও পারছে না। তাই তারা দ্বিতীয় আরেকটি কৌশল গ্রহণ করেছে এবং তা হচ্ছে মাদরাসা শিক্ষার ওপর পর্যায়ক্রমিক আঘাত এবং যুগ চাহিদার নামে মাদরাসা সিলেবাসকে এমনভাবে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন যাতে মাদরাসা থাকলেও এদেশের আলেম তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য, আলেমরাই প্রবল প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এ দেশে ইসলামকে জিন্দা রেখেছেন।

বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, খুতবা, ওয়াজ মাহফিল, সিরাত মাহফিল, কুরআন-হাদিসের তাফসীরসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক দিকনিদের্শনা ও শিক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইসলামের বাণী ও শিক্ষাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। মাদরাসা শিক্ষাকে পঙ্গু করে আলেম তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারলে এ দেশে ইসলামের ধ্বংস প্রক্রিয়া সহজতর হবে; বাঁশ না থাকলে বাঁশিও থাকবে না। এটাই তাদের বিশ্বাস, এই বিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তারা তৎপর থাকলেও নিভৃতে ও উন্নয়নের খোলসে এর আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আমলে। সেনা সমর্থিত বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে অবশ্য ইহুদী মুশরিকদের মদদে এর পটভূমি রচিত হয়েছিল।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, বিগত ২০০৮ সালে কার্ল জে সিওভাক্কো নামক একজন মার্কিন ইহুদী বিশ্লেষক ও সমরবিদ এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের সাথে যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশে মৌলবাদ ও ইসলামের প্রসার এবং মাদরাসা শিক্ষার বিস্তৃতি। Stemming the Rise of Islamic Extremism in Bangladesh শিরোনামে এই নিবন্ধটি Harvard International Review-তে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে দেশে ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান ঝোঁক প্রবণতাকে সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বিরাট হুমকি বলে গণ্য করা হয়েছে (Biggest threat to the Country’s Constitution and Secular underpinnings) এবং প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে অবশ্যই ইসলামের প্রবাহমান অগ্রযাত্রা রোধ করতে সক্ষম হবে। এই উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগকে এমন কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে ইসলামের গতি স্তব্ধ হয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের দীর্ঘ স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়। (It could roll back the growing tide of Islamism in Bangladesh to implement certain changes to proactively check Islamism to secure long-lasting secularism and democracy) নিবন্ধে জঙ্গিবাদ উত্থানের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ইসলামপন্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ি করা হয় এবং বলা হয় যে, ইসলামপন্থীরা আর্মিতে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চাতুর্যের সাথে সেনাবাহিনীতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য মাদরাসাসমূহে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছে। প্রবন্ধকারদের মতে, মাদরাসাসমূহে এই ভর্তি প্রশিক্ষণ চালুর আগে ২০০১ সালে আর্মিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ আসতো মাদরাসার ব্যকগ্রাউন্ড থেকে। কিন্তু এই প্রশিক্ষণ চালুর পর বিএনপি-জামায়াত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৬ সালের মধ্যে আর্মির নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে মাদরাসাছাত্রদের সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়। বাংলাদেশের ৩৭ বছরের ইতিহাসে চারটি সেনা অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রবন্ধে সশস্ত্র বাহিনীতে ইসলামপন্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কিছু দিকনির্দেশনা ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশও করা হয়েছে।

‘Toward Renewal : A Secular Plan’ শিরোনামে প্রদত্ত এই দিকনির্দেশনামূলক পরিকল্পনায় দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতিকে অরক্ষিত (Vulnerable) বলে গণ্য করা হয়। এতে প্রশ্ন করা হয়, Can the Awami League stop the growing tide of Islamism in a country that has seen the sale of burkas rise nearly 500 percent in last five years? অর্থাৎ যে দেশে বিগত পাঁচ বছরে বোরকার বিক্রি বার্ষিক ৫০০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে দেশে আওয়ামী লীগ কি ইসলামী জোয়ারের প্রবল প্রবাহ রোধ করতে পারবে? পাঁচ দফা পরিকল্পনার একটি রোডম্যাপ দিয়ে এর উত্তরে বলা হয়েছে যে, হ্যাঁ যদি দলটি এটি বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রবন্ধকারদের ভাষায়, “It must modernize the curriculum of the madrasas. Second it must build proper, secular elementary schools and hospitals. Third, it should increase the recruitment of secular minded students into the military. Fourth it must attempt to rehabilitate known extremist clerics. Lastly and perhaps the most abstract solution, it must push to vanquish poverty and illiteracy that consistently ranks among the worst in the world.” অর্থাৎ এই পরিকল্পনার প্রথম দফাটি হচ্ছে আবশ্যিকভাবে মাদরাসাসমূহের পাঠ্যক্রমের আধুনিকায়ন, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ প্রাথমিক স্কুল ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, তৃতীয়টি হচ্ছে সেনাবাহিনীতে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের নিয়োগ বৃদ্ধি, চতুর্থটি হচ্ছে সুপরিচিত চরমপন্থী আলেমদের পুনর্বাসন। অবশ্য চরমপন্থী বলতে তারা কাদের বুঝাতে চেয়েছেন এবং পুনর্বাসনেরই বা অর্থ কি তা পরিষ্কার নয়। তবে ধারণা করে নেয়া যায় যে, এক্ষেত্রে তাদের আঙ্গুল ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী হক্কানী আলেমদের দিকেই তোলা হয়েছে এবং তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থেকে তাদের বিরত রেখে অন্য কাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতি ইঙ্গিত করে। পরিকল্পনার পঞ্চম ধাপটি হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টা। এই তাৎপর্যপূর্ণ পরিকল্পনাটির বিস্তারিত বিশ্লেষণ এখানে সম্ভবপর নয়, তবে আমি যে বিষয়টিকে এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি তা হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার জন্য মাদরাসা কারিকুলামের আধুনিকায়নের নামে তা থেকে কুরআন, সুন্নাহ, উসুল, ফিকাহ প্রভৃতির এমনভাবে কাটছাঁট করা হয়েছে যাতে হক্কানী আলেম হবার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

উপরোক্ত পরিকল্পনাটি সম্পর্কে দেশের আলেম ওলামা এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের অধিকাংশই অবহিত যে ছিলেন তা নয়। যারা ছিলেন তাদের অনেকেই বিষয়টি ততো গুরুত্বের সাথে দেখেননি। অবশ্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার পুত্রের বয়সের স্বল্পতা ও অপরিপক্বতা হয়তো এর একটি কারণ থাকতে পারে। অনেকেই মনে করেছেন যে, কার্লজে সিওভাক্কোর ন্যায় একজন ইহুদী হয়তো সজীবের অবস্থানও তার মার্কিন স্ত্রীর সুযোগ নিয়ে যৌথ প্রবন্ধে তার ইসলামবিদ্বেষকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে থাকতে পারেন। এই ধারণাটির সত্যতা কতটুকু তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ক্ষমতা গ্রহণের পর যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে সিওভাক্কো ও তার অনুসারীদের সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মতাদর্শের কোন গড়মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রচার ও প্রসার রোধ করার জন্য মাদরাসাকে প্রধান টার্গেট হিসেবে গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। এ বিষয়টি সম্পর্কে দেশবাসীর বিস্তারিত কোনো ধারণা ছিল না। তবে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে উইকিলিক্স-এর ফাঁস করা তথ্যে সর্বপ্রথম দেশবাসী জানতে পারেন যে, সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তনে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উইকিলিক্সের তথ্যে বলা হয়, মাদরাসার পাঠক্রম পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ডিএফআইডি) এক সাথে কাজ করছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস্ এফ মরিয়ার্টি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের বিষয়টি উল্লেখ করে মাদরাসাগুলোর জন্য একটি পাঠক্রম তৈরি ও প্রয়োগের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন। এতে আরও বলা হয়েছে যে, মাদরাসা পাঠক্রম উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির দেয়া এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বস্তুত এই উদ্যোগটি বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন কিংবা ডিএফআইডি ও ইউএসএআইডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই উদ্যোগকে বহুমুখী করার লক্ষ্য হিসেবে আরও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও মাদরাসাবিরোধী তৎপরতার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও (এডিবি) বিশ্বব্যাংক উল্লেখযোগ্য। ঐ সময়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের মাদরাসাসমূহের পাঠক্রম পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে। এই ধারণাপত্রে দেশের মাদরাসাগুলোকে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের বড় ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে যে, সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সময় উপযোগী নয়। (চলবে)

https://dailysangram.com/post/430489