১২ অক্টোবর ২০২০, সোমবার, ১১:২০

রেলওয়ের করোনা রোধ

সুরক্ষাপণ্য ক্রয়ে বেশুমার চুরি

৭৫০ টাকার থার্মোমিটার কেনা হয় ১২৩০০ টাকায় * কেএন-৯৫ মাস্কের বাজার দর ১৫০-২৯৯ কেনা হয়েছে ৭২৭ টাকায় * ৫-৬ টাকা প্লাস্টিকের হ্যান্ড গ্লাভস কেনা হয় ৩২ টাকায়

করোনায় সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে রেলের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সংস্থাটি ৭৫০ টাকার ‘আইআর থার্মোমিটার’ কিনেছে ১২ হাজার ৩০০ টাকায়। ১২০ থেকে ২০০ টাকা দামের কেএন-৯৫ মাস্ক ৭২৭ টাকায় এবং ৬ টাকা দামের প্লাস্টিকের সাধারণ হ্যান্ড গ্লাভস ৩২ টাকায় কেনা হয়। সংস্থাটির ১৩টি দফতর একই ধরনের পণ্য প্রায় এ দামেই কিনেছে।

যাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার নামে এসব পণ্য কেনায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এ বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এসব পণ্যের চাহিদাপত্র দেয়ার সঙ্গে জড়িত এক দফতর কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে ওএসডি করা হয়েছে। এর আগে রেলওয়ে বাজারদরের চেয়ে ৩৪ গুণ বেশি দামে সাধারণ পণ্য কিনেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে জানান, রেলে কেনাকাটায় দুর্নীতির রিপোর্ট আমাদের হাতে এসেছে। সাধারণ সময়ের সঙ্গে করোনাকালীন সুরক্ষাসামগ্রী কেনায়ও দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কেউ রেহাই পাবে না।

ইতোমধ্যে অভিযোগ ওঠা কর্মকর্তাদের রেলভবনে এনে সুনির্দিষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে-কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে সাবধান করে দেয়া হয়েছে-চলমান তদন্তে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য এলে তাকে চাকরিচ্যুতসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। রেলে দিন দিন ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ-বাস্তবায়ন হচ্ছে। যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা বাড়ছে। অত্যাধুনিক নতুন ট্রেন চালুসহ রেলপথ নির্মাণ ধারাবাহিকভাবে করা হচ্ছে। এসব অর্জন দুর্নীতির কারণে ম্লান হতে পারে না।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল দুই ভাগে বিভক্ত। করোনা সুরক্ষাসামগ্রী কেনায় দুর্নীতি হয়েছে পূর্বাঞ্চলে এবং সাধারণ পণ্য কেনায় অনিয়ম হয় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলের কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা করোনা শুরুর আগে পূর্বাঞ্চল রেলে বদলি হয়ে আসেন।

বদলি হয়ে আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন করোনা সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে একজনকে ইতোমধ্যে ওএসডি করা হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টি তদন্তের জন্য রেলওয়ের এক যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কেনাকাটার সঙ্গে আর্থিক ক্ষতিসহ অন্যান্য দিকও তদন্ত করে দেখবে। কমিটিকে এ মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। আমরা সব ধরনের কাগজপত্র চাচ্ছি। হাতে পাওয়া কাগজপত্রেও অনিয়ম স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমরা আরও কিছুদিন সময় চেয়েছি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়া হবে।

জানা গেছে, সুরক্ষাসামগ্রী হিসেবে আইআর থার্মোমিটার ইনফ্রারেড মডেল নং টিজি-৮৮১৮বি, চায়না কেনা হয়েছে ১২ হাজার ৩০০ টাকা দরে, যার বাজারমূল্য ৭৫০ টাকা। কেএন-৯৫ মাক্স কেনা হয়েছে ৭২৭ টাকা দরে, যার বাজারমূল্য ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এক সরবরাহকারী জানান, প্রতি পিস মাস্কের জন্য তাকে দেয়া হয়েছে ২৮০ টাকা।

প্রতি পিস হ্যান্ড গ্লাভসের বাজারমূল্য যেখানে ৫/৬ টাকা, সেখানে কেনা হয়েছে ৩২ টাকা করে। প্লাস্টিকের স্প্রে বোতল বাজারমূল্য ১৫ থেকে ৩০ টাকা, সেখানে কেনা হয়েছে ৩৪৮ টাকায়। শুধু পরিবহন দফতরে ২০০ থার্মোমিটার ক্রয়ে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। মাস্ক কেনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

এছাড়া হ্যান্ড গ্লাভস, হেস্কিসল, খালি স্প্রে বোতল, স্যাভলন বোতল বাজারমূল্যের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে। শুধু পরিবহন নয়, এমন ১৩টি দফতরে একই ধরনের কেনাকাটা করা হয়েছে। যেখানে বাজারমূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি মূল্যে করোনা প্রতিরোধ সামগ্রী ক্রয় করা হয়েছে।

পণ্য সরবরাহকারীদের মধ্যে একজন মো. ইকবাল। তিনি নিউ কনফিডেন্স ঠিকাদার কোম্পানির স্বত্বাধিকারী। মো. ইকবাল যুগান্তরকে বলেন, করোনার সময় আমি পূর্বাঞ্চল রেলে ২৯০০টি কেএন-৯৫ মাস্ক ২৮০টাকা দরে দিয়েছি। একই সঙ্গে আরও কিছু করোনাসামগ্রী তাদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করেছি।

অন্যরা কত দামে রেলকে মাস্ক দিয়েছে, তা আমার জানার কথা নয়। আমি যে দরে দিয়েছি, তা বলেছি। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন দফতর থেকে মালামাল ক্রয়ের চাহিদাপত্র আসে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দফতরে। এ দফতরই মালামাল ক্রয়ের অনুমোদন দেয়। নির্ধারিত টাকার উপরে মালামাল ক্রয় করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিতে হয়।

এ বিষয়ে রোববার বিকালে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রুহুল কাদের আজাদ যুগান্তরকে জানান, করোনাকালে পূর্বাঞ্চল রেলে কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, বাজারমূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে কেনাকাটা করেছি।

ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তদন্ত কমিটির কাছে সব ধরনের কাগজপত্র দিয়েছি। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে নিশ্চয় আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলে সংশ্লিষ্টদের চাহিদাপত্র অনুযায়ী আমরা কেনাকাটা করেছি। বাজারদর মূল্যায়নের জন্য আমার দফতর এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের (যারা চাহিদাপত্র দিয়েছেন) ৩ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে কমিটি গঠন করেই সব কেনা হয়েছে।

তিনি বলেন, মাস্ক, থার্মোমিটার ক্রয়ে বাজারমূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি দরে কেনা হয়েছে, এটা ঠিক নয়। প্রথমদিকে করোনাসামগ্রীর মূল্য অনেক বেশি ছিল। তাছাড়া আইআর থার্মোমিটারের দাম ১২ হাজার ৩০০ টাকা হওয়ার কথা নয় বলেও তিনি জানান।

এদিকে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় ৩৩ গুণ বেশি দামে মালামাল ক্রয় করা হয়েছে বলে অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে। ওই অঞ্চলে লেভেল ক্রসিং গেটে ব্যবহৃত বিভিন্ন মালামাল বাজারমূল্যের চেয়ে ২৮ গুণ বেশি দামে ক্রয় করা হয়। এতে প্রায় ২৭ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

একই সঙ্গে লেভেল ক্রসিং সংলগ্ন ঘণ্টি ঘরে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের মালামাল বাজারমূল্যের চেয়ে অধিক মূলে ক্রয় করায় প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে- গার্ডদের জন্য লাগেজ ট্রলি সরবরাহ না করা সত্ত্বেও তার বিল পরিশোধ করা হয়েছে ২২ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬০ টাকা।

দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত অসাধু কর্মকর্তারা রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয়া হলেও যাতে ব্যবস্থা না নেয়া হয়, সেজন্য তদবির করছেন। সংস্থাটির অনেকেই অভিযোগ করেছেন-প্রকৃত দোষী কিংবা দুর্নীতিবাজদের এর আগেও আড়াল করা হয়েছে। এবারও যা শুরু হয়েছে, তাতে পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তির শঙ্কা আছে।

তারা বলেন, দুর্নীতি করার পর গুটিকয়েক চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। চাহিদাপত্র দেয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা এএসএম শাহনেওয়াজকে ওএসডি করায় রেলে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদাপত্র যে কোনো সময় যে কোনো দফতর দিতে পারে।

কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী মালামাল ক্রয় করা-না-করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক/প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দফতরের। কোনো কেনাকাটায় চাহিদা প্রদানকৃত দফতর সম্পৃক্ত থাকে না। যেসব কর্মকর্তা কেনাকটায় জড়িত, অনুমোদনকারী তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে এএসএম শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কর্মকর্তাদের একটি অংশ।

এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক শামছুজ্জামান জানান, উভয় অঞ্চলে কেনাকাটায় দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে কেনাকাটায় দুর্নীতি-অনিয়মের একটি রিপোর্টও দেয়া হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে করোনাকালে কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে একজনকে ওএসডি করা হয়েছে।

সরাসরি কেনাকাটায় জড়িতদেরও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমাদের লোকবলের অভাব থাকায় অনিয়ম-দুর্নীতির কিছু প্রমাণ পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কারোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। রেলওয়ে সচিব মো. সেলিম রেজা যুগান্তরকে জানান, করোনা প্রতিরোধে পূর্বাঞ্চল রেলে বিভিন্ন মালামাল কেনায় দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে কারও অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়লে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/353936