২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৪৬

ভাঙনে বিলীন দুই শতাধিক স্কুল

নদীর গ্রাসে হাজার কোটি টাকা

দেশে প্রতি বছর নদীগর্ভে প্রায় দুশ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে পানিতে ভেসে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাই বেশি। পাড় ধস শুরুর পরও একতলা ভবন দোতলা করার নজির আছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাটিসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।

সরকারের এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই। আছে শুধু নির্দেশনা কিন্তু তাও উপেক্ষিত। বেছে বেছে এমন স্থানে ভবন নির্মাণের সঙ্গে একটি চক্র জড়িত। তারা স্কুলের জন্য বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম ব্যয় করে বাকি টাকা পকেটে তুলছে। নির্মিত ভবন নদীতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার এর মান পরীক্ষারও কোনো সুযোগ থাকছে না।

এতে সরকারের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। একই সঙ্গে অনেক এলাকা স্কুলশূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারও পড়ছে বিপাকে। সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাঝপথে ঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে কোনো নীতিমালা নেই। শুধু নির্দেশনা আছে যে, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। এ ক্ষেত্রে চর্চা হচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয় বিদ্যালয় নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করে থাকে।

অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতিবিদসহ প্রভাবশালীরা এই স্থান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে নদীভাঙনের প্রবণতা বিচার-বিশ্লেষণ বা আমলে নেয়া হয় না। প্রভাবশালীরা নিজের সুবিধামতো স্থানে বিদ্যালয়ের জন্য পাকা ভবন তৈরির পরামর্শ দেন। ফলে ফি বছরই সরকারের গচ্চা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

বিদ্যালয় নির্মাণে নীতিমালা না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে স্থান নির্বাচন করে দেয়া হয়। এরপর সেই তালিকা ধরে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়।

তবে বিদ্যালয় নির্মাণের ব্যাপারে আমরা এখন নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্ষতিরোধে ‘স্থানান্তর করা যায়’- এমন ডিজাইনের স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী সংক্রান্ত মরফোলজিক্যাল রিপোর্ট। এ ক্ষেত্রে ভাঙনের আশঙ্কা না থাকে তাহলে নদীর এক কিলোমিটারের মধ্যেও বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করলে সমস্যা হবে না।

জানা গেছে, দেশের ৩৫টি জেলা সবচেয়ে বেশি নদী ভাঙনপ্রবণ। গত ২০ বছরে এসব জেলায় প্রায় ৮ হাজার স্কুল, কলেজ, মসজিদ মাদ্রাসা ভেঙে নদীগর্ভে চলে গেছে। এর মধ্যে কোনো বিদ্যালয় আছে নির্মাণের পর উদ্বোধনের আগেই ভেঙেছে। কোনোটি নির্মাণের কিছুদিন পর ভেঙেছে। চলতি বছরের বন্যায় মধ্য আগস্ট পর্যন্ত হিসাবে ৩ হাজার ৯১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এর মধ্যে ভাঙনের মুখে পড়ে নদীগর্ভে চলে গেছে ৪৭টি। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার সংখ্যাও প্রায় দু’ডজন। মৌসুম শেষ না হওয়ায় ভাঙনকবলিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন চূড়ান্ত হয়নি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় ভাঙন তীব্র আকার নেয়। সে হিসাবে এবার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরও বাড়বে। ২০০৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে ২শ’ বিদ্যালয় নদীভাঙনের শিকার হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এদিকে সরেজমিন দেখা গেছে, রাজশাহীর বাঘায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে লক্ষ্মীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯৮ সালে ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এই বিদ্যালয়ের একতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে ২০১১ সালে তা দোতলা করা হয়।

এলাকাটি এখন বিদ্যালয়শূন্য হয়ে গেছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণের অর্থও জলে গেছে। নদীতে বিলীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চরবজরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও একটি। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় দুই বছর আগে তিস্তা নদী থেকে মাত্র আড়াইশ’ ফুট দূরে এটি নির্মাণ করা হয়।

এবারের বন্যায় তিস্তার প্রবল ভাঙনে ওই পাকা স্থাপনাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে জানান, দুই বছর ধরেই নদীটিতে ভাঙন চলছিল। এই ভাঙনের মধ্যেই ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতল পাকা ভবনটি তৈরি করা হয়। অথচ একটু দূরে নির্মাণ করা হলে এমন দুর্ঘটনার শিকার হতে হতো না।

এছাড়া উলিপুরের উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের চরজুয়ান সতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খারিজা লাটশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাতিয়া ইউনিয়নে নয়াডারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও বিলীন হয়ে গেছে এবারের বন্যায়। তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্র ভাঙনকবলিত হওয়া সত্ত্বেও আগে থেকে এসব বিদ্যালয় রক্ষায় চেষ্টা করা হয়নি। একই অবস্থা হয়েছে মেঘনা পাড়ের এলাকা বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে।

উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের চরবগী চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গত ২৬ আগস্ট মেঘনার গ্রাসে চলে গেছে। পদ্মাপাড়ের এলাকা মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শরীয়তপুরের নড়িয়ায় বসাকের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনও বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে।

২০০৯ সালে নির্মিত একই উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের নুরুদ্দিন মাদবরকান্দি এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়টি এবারের বন্যায় পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তখন তিন কিলোমিটারের বেশি দূরে নদীর অবস্থান ছিল। এভাবে দেশের অনেক এলাকায়ই নদীর কাছে বিদ্যালয় ভবন তৈরি করা হচ্ছে। অধিকাংশ সময়ে ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে স্থাপনা। বিদ্যালয় ভবন নদীভাঙনের শিকার হলে বিঘ্নিত হয় ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, মাটি পরীক্ষা করে বিদ্যালয় নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নির্মাণ না করার ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি ‘ম্যানুয়াল’ আছে। ২০০৮ সালে দায়িত্বে থাকাকালে আমরা এটা করেছিলাম।

তাছাড়া নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৌশলীদেরও কিছু নীতি অনুসরণের রীতি থাকে। এসবের অনুসরণ করা হলে বিদ্যালয় নদীভাঙনের শিকার হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে সমীক্ষায় তারা পেয়েছেন যে, বছরে অন্তত ২শ’ বিদ্যালয় নদীভাঙনের শিকার হয়। প্রায় প্রত্যেক গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তাই এ ধরনের বিদ্যালয়ই বেশি ভাঙনের শিকার হচ্ছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় যেহেতু বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয় তাই দেখেশুনেই স্থানীয়রা তা নির্মাণ করেন। আর মাধ্যমিকে যা ভাঙনের শিকার হয় তার কতক সরকারিভাবে দেয়া ভবন, বাকিগুলো বেশ পুরনো প্রতিষ্ঠান।

দেশে নদী ভাঙন নিয়ে কাজ করে থাকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। সংস্থাটির সহযোগী বিশেষজ্ঞ সুদীপ্ত কুমার হোড় যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবছর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীভাঙনের শিকার হয়। নদীর গতিবিধি এবং স্যাটেলাইটে প্রাপ্ত এ সংক্রান্ত তথ্যের ওপর গবেষণা করে ভাঙন ঝুঁকির স্থান চিহ্নিত করে থাকেন তারা। অবশ্য তারা এক বছরের পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। দু’বছরের পূর্বাভাস দেয়ার কাজ করছেন তারা। এই পূর্বাভাস অনুসরণ করে নির্মাণ কাজ করা হলে বা প্রতিষ্ঠান আগে থেকে স্থানান্তর করা হলে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে থাকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি)। মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম গোলাম ফারুক বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করা শেষ হয়নি। নদীভাঙন প্রবণ এলাকায় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে নীতিমালা আছে কি না সেটা ইইডি বলতে পারবে।

ইইডির প্রধান প্রকৌশলী বুলবুল আখতার বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোথায় নির্মিত হবে সেই তালিকা মাউশি থেকে তাদেরকে দেয়া হয়। তারা কেবল প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ করেন। তবে এটা মাউশির কমিটি এবং স্থানীয় পর্যায়ের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় বলে জানেন তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/349558/