২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৩৫

এমসি কলেজের বর্বরতম ঘটনা ও নিরাপত্তা কর্মসূচির অর্থ অপচয়

-ড. মো. নূরুল আমিন

॥ এক ॥
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সিলেটের এমসি কলেজ হোস্টেলে একটি বর্বরতম ঘটনা ঘটেছে। মহানগরীর দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দা একটি দম্পতি মনোরম কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে যান। তারা অথবা তাদের যেকোনো একজন হয়তো ঐ কলেজের ছাত্র ছিলেন অথবা করোনাকালের দীর্ঘ কয়েক মাসের বিচ্ছিন্ন জীবনের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য তারা নিরিবিলি পরিবেশের কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। তাদের জানা ছিল না যে, হোস্টেল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ রয়েছে। তাদের প্রাইভেট কারটি ক্যাম্পাসে যাবার সাথে সাথেই ছাত্রলীগের ৯ জন নেতা-কর্মী তাদের ঘিরে ফেলে এবং জোরপূর্বক হোস্টেল কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে স্বামীকে বেঁধে রেখে তার সামনেই তার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে। ঘটনার দু’তিন ঘণ্টা পর শাহপরান থানার পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে এবং নয়জনকে আসামী করে থানায় মামলা করা হয়। এই কলামটি লিখার সময় পর্যন্ত পুলিশ দুইজন অপরাধীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পুলিশি অভিযানে এদের মধ্যে একজনের কক্ষ থেকে পাইপগানসহ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ধরনের বর্বর ঘটনা আফ্রিকার জঙ্গলেও ঘটতে পারে বলে আমার মনে হয় না। সরকার ও তার অঙ্গ সংগঠন দেশটিকে কোথায় নিয়ে গেছেন তা আমি ভেবে পাইনি এবং এর নিন্দা করার ভাষাও আমি হারিয়ে ফেলেছি। প্রতিদিন, প্রতিমাস, প্রতিবছরই ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অনৈতিক, সমাজবিরোধী ও উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যদিও নতুন নতুন ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে তথাপিও ২০১০ সালের একটি ঘটনা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের মহিলা শাখার কিছু অনৈতিক কর্মকাণ্ড সারা জাতির বিবেককে তখন প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। ইডেন মহিলা কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ ও আনন্দ মোহন কলেজের সাধারণ ছাত্রীদের উপর তাদের নিপীড়ন পত্রপত্রিকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তখন কলেজের জুনিয়র মেয়েদের উপর সিনিয়র মেয়েদের অবৈধ ও অনৈতিক নির্দেশের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং হোস্টেলে সিট প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে অনৈতিক কাজ করতে তাদের বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল। ইডেনের ছাত্রীরা সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিল যে, ছাত্রলীগের মহিলা নেত্রীরা তাদের সিনিয়র নেতা, রাজনীতিক, শিল্পপতি ও বিদেশীদের মনোরঞ্জন এবং তাদের সাথে রাত্রি যাপনের জন্য তাদের বাধ্য করতো এবং নির্দেশ অমান্য করলে -পুরুষ ও নারী শাখার নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদকাশক্তি, জুয়া ও ক্যাসিনো আসক্তি, অস্ত্রবাজি-দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি ও গোলাগুলির ঘটনা তারা অহরহ ঘটিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন প্রভৃতি তো আছেই।

মা-বোনদের উপর তাদের নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এর মাধ্যমে তারা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের কলঙ্কিত করছে। দুঃখজনকভাবে সরকারও তাদের উপর ভর করে সারা দেশে ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে ক্ষমতার মসনদকে নিষ্কণ্টক রাখার চেষ্টা করছে। সিলেটের মতো মহানগরীতে এমসি কলেজের প্রকাশ্য চত্বরে প্রাইভেট কার থেকে জোরপূর্বক বের করে হোস্টেল কক্ষে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের মতো ঘটনা ইতঃপূর্বে দুনিয়ার কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। এটা আমাদের জাতিসত্তা, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত। এই আঘাত প্রতিহত করার এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের রক্ষার জন্য এই অভিশপ্ত ছাত্র সংগঠনটিকে অবিলম্বে বেআইনি ঘোষণা করা দরকার। যে কোনো রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের উৎস হচ্ছে ছাত্র সংগঠন। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ প্রমাণ করেছে যে, নেতৃত্ব তৈরির মতো যোগ্যতা তাদের নেই। তারা অধঃপতিত, নৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া ও অভিশপ্ত। এদের বিরুদ্ধে দেশবাসীর সোচ্চার হওয়া উচিত।

॥ দুই ॥
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ অর্থ টার্গেটভুক্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে না বলে জানা গেছে। এই অর্থ স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে হয় ধনীরা পাচ্ছে অথবা আত্মসাৎ হয়ে যাচ্ছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ কর্তৃক দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিচালিত “সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে সুযোগ-সুবিধা বিতরণে দক্ষতা” শীর্ষক এক সমীক্ষায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। এতে আরো দেখা গেছে যে, সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাধীন মাধ্যমিক স্কুলের বৃত্তি কর্মসূচিটি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত যেখানে ৭২ ভাগ অর্থ নির্ধারিত দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে না, মাত্র ২৮ ভাগ ছাত্রছাত্রী তাদের প্রাপ্য বুঝে পায়। সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বেশ কিছু সংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও চেয়ারম্যান এবং সরকারি কর্মকর্তা এই মর্মে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তারা মাতৃত্ব ও বয়স্ক ভাতার জন্য লোক নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেন এবং কার্ড ইস্যু করেন। সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো জনাব তৌফিকুল ইসলাম খান সমীক্ষার ফলাফল পেশকালে আরো বলেছেন যে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্রতম অংশ মাত্র উপকৃত হচ্ছে। লক্ষ্য ভুক্ত দরিদ্র জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৩২.৫ শতাংশ এর মধ্যে সরকারি সুবিধার অংশ বিশেষ পেয়েছেন। অন্যদিকে তাদের জন্য নির্ধারিত না হলেও দরিদ্র বহির্ভূত ১৯.৮ ভাগ লোককে এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরা প্রকৃতপক্ষে ধনী। রংপুর বিভাগের চারটি জেলা যথাক্রমে নিলকামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলায় মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল বৃত্তি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি এবং বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি এই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী দরিদ্রদের মাত্র ৩৪.৪ শতাংশ নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে সহায়তা পেয়েছে, সাহায্যপ্রাপ্ত অবশিষ্ট ৬৫.৬ শতাংশ সহায়তা পাবার অযোগ্য ধনী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। বয়স্ক ভাতার ক্ষেত্রে ৩২.২ শতাংশ দরিদ্র এবং ৬৭.৮ ভাগ ধনী, মাতৃত্বকালীন ভাতার ক্ষেত্রে সুবিধাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪১.৫ শতাংশ দরিদ্র এবং ৫৮.৫ শতাংশ ধনী। আবার অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির অধীনে সুবিধাভোগীদের বেলায় ৪৯.৬ শতাংশ দরিদ্র। পক্ষান্তরে ৫০.৪ শতাংশ সুবিধাভোগী যাদের দরিদ্র হিসাবে দেখানো হচ্ছে তারা প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র নয়। একইভাবে মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে প্রদত্ত বৃত্তির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে, কেবলমাত্র ২৮ শতাংশ সুবিধাভোগী ছাত্রছাত্রী দরিদ্র পরিবারের, অবশিষ্ট ৭২ শতাংশ ধনী পরিবারের। প্রাথমিক স্কুলের বেলায় এই হার হচ্ছে যথাক্রমে ৩৬.২ শতাংশ ও ৬৩.৮ শতাংশ।

গাইবান্ধা জেলায় পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সেখানকার মোট সুবিধাভোগীদের মধ্যে ৪৩.৯ শতাংশ পরিবার ধনী, কুমিগ্রাম, নিলফামারী ও রংপুরে এদের হার যথাক্রমে ৩০.৪ শতাংশ, ৩৪.১ শতাংশ এবং ২১.৬ শতাংশ।

রিপোর্ট অনুযায়ী পাঁচ জেলার প্রায় ৬৭.৮ শতাংশ সুবিধাভোগী ধনী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, মাত্র ৩২.২ শতাংশ দরিদ্র। মাতৃত্বকালীন ভাতার বেলায় ৪১.৫ শতাংশ সুবিধাভোগী দরিদ্র, অবশিষ্ট ৫৮.৫ শতাংশ পরিবারকে দরিদ্র না হওয়া সত্ত্বেও এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির অর্ধেকেরও বেশি সুবিধাভোগী দরিদ্র নয়। রিপোর্টটিতে এটা পরিষ্কার যে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, দলপ্রীতি এবং অবৈধ প্রভাব ও দক্ষতার অভাবে সমাজের বিত্তহীন দরিদ্রও অতিদরিদ্র এবং অসহায়দের জন্য রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে এবং এর বেশিরভাগ যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও তাদের পোষ্য ও দলীয় লোকজনদের পকেটে। এটি একটি বিরাট অপচয় এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপব্যবহার। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ২০১৮-২০১৯ সালের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক ক্ষমতায়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ৬৪,১৭৬.৪৮ কোটি টাকা। এ থেকে যদি টার্গেট বহির্ভূত খাতে ৬৭.৮% চলে যায় তাহলে তার অর্থ হচ্ছে ৪৩,৫১১.৬৭ কোটি টাকার অপচয় বা দুর্নীতি। এর ভাগ শুধু টার্গেট বহির্ভূতরা পাচ্ছে না সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও পাচ্ছে। এই অপচয় রুখতে হবে।

https://dailysangram.com/post/428951