সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে দল বেঁধে ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করেন।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ৬:৫৬

সিলেটে বেপরোয়া ছাত্রলীগ

► অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ১০ বছরে ১১ খুন
► বেশির ভাগ অপকর্মই এমসি কলেজে
► আওয়ামী লীগের দুই নেতা দুই গ্রুপের নেতৃত্বে
► জেলায় তিন বছর, মহানগরে এক বছর ও এমসি কলেজে ১০ বছর কমিটি নেই

এক দশক ধরে সিলেটে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ ক্রমেই বেড়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজ দলের কর্মীকে খুন, মারামারি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে সরকারদলীয় ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্রসংগঠনটি। আর নগরের মধ্যে এমসি কলেজকে কেন্দ্র করে সেখানকার ছাত্রলীগকর্মীরা একের পর অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ ১০ বছর ধরে ওই কলেজটিতে ছাত্রলীগের কোনো কমিটিই নেই। অন্যদিকে তিন বছর ধরে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। এক বছর ধরে নেই মহানগর কমিটি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ বছরে সিলেটে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অন্তত ১১ জন খুন হয়েছেন। যার বেশির ভাগই ঘটেছে নগরের টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। একই সময়ে কলেজটির ঐতিহ্যের অংশ ব্রিটিশ আমলের ছাত্রাবাসটি পুড়িয়ে দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে এক তরুণীকে স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের কর্মীরা।

জানা গেছে, টিলাগড় ছাত্রলীগের একটি অংশকে নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রনজিত সরকারের অনুসারী হিরন মাহমুদ নিপু। অন্য অংশের নেতৃত্ব দেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের অনুসারী ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রায়হান আহমদ চৌধুরী। একসময় তাঁরা একই গ্রুপে রাজনীতি করতেন। কিন্তু পরে বিভক্তি দেখা দেয়। এ দুই গ্রুপের আবার বিভিন্ন উপগ্রুপ রয়েছে। এখন এমসি কলেজকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কয়টি গ্রুপ আছে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে মূলত দুই নেতাকে ঘিরেই গ্রুপগুলো কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।

২০১০ সালের ১২ জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে নগরের টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এর পরই এমসি কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। সেই থেকে কমিটিহীন ছাত্রলীগ এমসি কলেজে তৎপরতা চালাচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে নগরের টিলাগড় পয়েন্টে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা তানিম আহমদ খান। ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর একই টিলাগড়ে ছাত্রলীগকর্মী ওমর আহমদ মিয়াদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে এ ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রায়হান চৌধুরীসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হলেও পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ হত্যাকাণ্ডের জেরেই বাতিল করা হয় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটিও।

একই মাসে নগরের শাহজালাল উপশহরে প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে খুন হন হুসাইন আল জাহিদ নামের এক ছাত্রলীগকর্মী। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিপক্ষের হাতে ছাত্রলীগকর্মী অভিষেক দে দ্বীপ নিহত হন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা রনজিত গ্রুপের অনুসারী ছিলেন।

২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জ এলাকায় প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ছাত্রলীগকর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সমর্থিত সুরমা গ্রুপের কর্মী ছিলেন। হামলাকারীরা আজাদ গ্রুপের কর্মী ছিলেন বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল মাসুমের সহপাঠীদের।

২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগের কর্মীরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেন। পরে এটি ২০১৪ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ আবারও ছাত্রাবাস ভাঙচুর করে। ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট ছাত্রাবাস দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে এক সপ্তাহ ছাত্রাবাস বন্ধ থাকে।

২০১৬ সালে এমসি কলেজে পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর ক্যাম্পাসের ভেতরই খাদিজা বেগম নামের এক ছাত্রীকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। ওই ঘটনার অভিযুক্ত ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতা। যা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।

চলতি বছরের ১১ মে সিলেট ছাগল উন্নয়ন খামার থেকে ফ্রি খাওয়ার জন্য একটি পাঁঠা চেয়ে না পেয়ে এক কর্মকর্তার ওপর হামলা ও ভাঙচুর করেন এমসি কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রনজিত সরকারসহ ১০ জনকে আসামি করে থানায় মামলাও হয়।

এদিকে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগেও একাধিক গ্রুপ রয়েছে। এ দুই শাখায় ঠিক কতটি গ্রুপ-উপগ্রুপ রয়েছে তা নেতারাও জানেন না। একেক নেতাকে কেন্দ্র করে একেক এলাকায় ছাত্রলীগের গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপ টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের সঙ্গে জড়িত।

২০১৪ সালের ১৪ জুলাই সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট-কালীবাড়ি রোডের মদিনা মার্কেট অংশে ইজি বাইকের (টমটম) একটি নতুন স্ট্যান্ডের দখল নিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা ইমরান আহমদ ও গোলজার আহমদ গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ছাত্রলীগকর্মী আবদুল্লাহ ওরফে কচি নিহত হন। ওই বছরের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের পার্থ-সবুজ গ্রুপের সঙ্গে অঞ্জন-উত্তম গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী সুমন চন্দ্র দাস।

২০১৫ সালের ১২ আগস্ট মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ দলের ক্যাডারদের হাতে খুন হন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল আলী (১৯)। তিনি ছাত্রলীগ বিধান সাহা গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী কাজী হাবিবুর রহমান প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন।

সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি হয় ২০১৫ সালের ২০ জুলাই। তখন আব্দুল বাছিত রুম্মানকে সভাপতি ও আব্দুল আলীম তুষারকে সাধারণ সম্পাদক করে মহানগর ছাত্রলীগের চার সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন বছরেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে না পারা এবং নানা অভিযোগে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এ কমিটি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2020/09/28/960000