২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১০:১৮

অনড় দখলদার প্রভাবশালীরা

আজ বিশ্ব নদী দিবস

নদী দখলদার প্রভাবশালীদের টনক নড়ানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। ৫০ হাজার দখলদারের কারণে দেশের নদীগুলোর বেঁচে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যার তালিকায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী, শিল্পপতি, গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষও রয়েছেন। এদের কেউ বালু-পাথর ব্যবসার মহাল করেছেন, কেউ শিল্পকারখানা আবার কেউ সাধারণ স্থাপনা গড়ে নদী দখলে রেখেছেন। নদী রক্ষায় গঠিত ‘নদী কমিশন’ বলছে দখল হওয়া নদীর মধ্যে গত ছয় বছরে তারা চার ভাগের মাত্র এক ভাগ উচ্ছেদ করতে পেরেছেন। এরা সাধারণ দখলদার। কিন্তু প্রভাবশালীরা আজো দখলে অনড়। একাধিকবার নোটিশ দেয়ার পরও তাদের টনক নড়ছে না। প্রভাব খাটিয়ে তারা দখল ধরে রেখেছেন।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে খোদ নদী কমিশন নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলছেন, ২০১৪ সালে নদী রক্ষায় কমিশন গঠন করা হলেও আজো তাদের সরাসরি উচ্ছেদের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তারা শুধু নির্দেশ দিতে পারেন। তা কার্যকরের ক্ষমতা স্থানীয় জেলা প্রশাসকদের। ফলে পরোক্ষভাবে তাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া কার্যক্রম সুষ্ঠু পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যয় ঘাটতি সঙ্কুলান ও সৎ লোকের প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে কমিশন কাজ করছে। কিন্তু যে গতিতে আমাদের কাজ করা দরকার তা আমরা পারিনি। কারণ দখলদার প্রভাবশালীদের নানা অপতৎপরতায় কখনো কখনো আমাদের বাধাগ্রস্ত হতে হয়। উচ্ছেদের বিষয়ে একাধিক মন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েও তা পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, এখন মনে হচ্ছে প্রভাবশালী উচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা লাগবে।

দখলদারদের কারণে নদীর বেঁচে থাকা অনিশ্চিত জানিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ আমরা ৫০ হাজার দখলদারের তালিকা প্রকাশ করেছি। এদের মধ্যে নদী কমিশন গঠনের পর গত ছয় বছরে ২৫ শতাংশকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকিদের উচ্ছেদ চেষ্টার পাশাপাশি বাদ পড়া দখলদারদের নতুন তালিকাও করা হয়েছে, যা এ বছর প্রকাশ হবে।

নদী কমিশনের প্রকাশিত দখলদারদের তালিকায় দেখা যায়, রাজধানীর চার দিকে অবস্থিত শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদ-নদীতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান নদীর জায়গা দখলে রেখেছে। শীতলক্ষ্যা ভরাট করে চলছে বালুর ব্যবসা। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অনেকগুলো ডকইয়ার্ড। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি অন্তত চার হাজার ৮০০ বর্গফুট নদী ভরাট করেছে বলে সরকারি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া দোকানপাট, ঘরবাড়ি বানিয়েও নদী-খাল দখলে নেয়া হয়েছে। রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, চাক্তাই খালসহ দেশের প্রায় সব বড় নদ-নদীও একই কায়দায় দখল করা হয়েছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। নদী রক্ষা, উন্নয়ন মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং পরিবেশ রক্ষার প্রতিপাদ্যে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্বে ধাপে ধাপে ১৯৮০ সাল থেকে পালিত হয়ে এলেও বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে পালন শুরু হয়। এ উপলক্ষে আজ নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থা ও পরিবেশবাদী জোট দেশে দিবসটি পালন করছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা নদী গবেষণাগার, বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, রিভার বাংলা, দ্য ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব এপেক্স ক্লাবস বাংলাদেশ, হালদা নদী রক্ষা কমিটি, জিবিএম বেসিন বেইজড পিপলস নেটওয়ার্ক, ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন, ক্লিন রিভার বাংলাদেশ এবং পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটি।

এক সময়ে বাংলাদেশে ছোট-বড় সাড়ে ১১শ’ নদ-নদী ছিল। বর্তমানে ৪০৫টি রয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে রাজধানীসহ দেশের নদীগুলোতে দখল দূষণ না থামলেও ধীরগতিতে চলছে নদী রক্ষায় অভিযান। ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগসহ বিভিন্ন নদী উদ্ধারে দফায় দফায় অভিযান চালানো হলেও এখন অনেকটা থেমে আছে কার্যক্রম। ফলে প্রভাবশালীদের অপতৎপরতা আর বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় দূষণ থামছে না। কলকারখানার রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে দিন দিন তা বিপজ্জনক অবস্থায় রূপ নিচ্ছে। তবে নতুন করে আর দখল না হলেও আগে বেদখল নদী উদ্ধারে তৎপর রয়েছে উদ্ধারকারীরা।

পরিবেশ অধিদফতরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ২৯টি প্রধান নদ-নদীর দূষণমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এগুলোর পানির দূষণ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছাচ্ছে। সমীক্ষা বলছে, মূলত নদীগুলোর তীরে গড়ে ওঠা বেশির ভাগ শিল্পকারখানা তাদের বর্জ্য পরিশোধন না করে নদীতে ফেলছে। কারখানাগুলোতে বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও বেশির ভাগই চালানো হচ্ছে না। কৃষিকাজে ব্যবহৃত হওয়া মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশকও সেচের পানির সাথে ধুয়ে নদীতে পড়ছে। হাটবাজার, শহর ও বস্তি এলাকার গৃহস্থ বর্জ্য ফেলার সবচেয়ে বড় ভাগাড়ও এই নদী।

নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বলেছেন, দেশের নদ-নদীগুলো প্রধানত পাঁচটি সঙ্কটে পড়েছে। এগুলো হলো- প্রবাহ স্বল্পতা, দখল, দূষণ, বালু-পাথর উত্তোলন ও ভাঙন। এর বাইরে আরেকটি বড় কারণ দূষণ। ঢাকার চারপাশের চার নদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদীর দূষণ সীমাহীন। এর বইরে সারা দেশে চলছে দখল-দূষণের আগ্রাসী প্রতিযোগিতা। মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও নানা ফাঁকফোকর আর সীমাবদ্ধতায় তা থমকে যায়।

অবশ্য এরই মধ্যে ঢাকার চার পাশের নদীগুলো ছাড়াও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী দখলমুক্ত দূষণমুক্ত করে নাব্যতা ফেরাতে ১০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। নদী রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি এরই মধ্যে একটি খসড়া মাস্টারপ্লান করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহাপরিকল্পনাকে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’, ‘স্বল্পমেয়াদি’, ‘মধ্যমেয়াদি’ ও ‘দীর্ঘমেয়াদি’ পরিকল্পনায় ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ওয়াকওয়ে নির্মাণ, স্যানিটেশন, দূষিত পানি যেন নদীতে না যায় সেজন্য ঢাকার স্যুয়ারেজ লাইনও ঠিক করা, নদীতে ড্রেজিং, পানিতে আর যাতে দূষিত পদার্থ না যায় সেজন্য সোর্সগুলো বন্ধ করা।

এর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ঢাকার ওই চার নদ-নদীর সুরক্ষা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং এর ভূমি পুনরুদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপর গত বছরের ২৯ জানুয়ারি থেকে নদীরক্ষায় শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। সরকারি তথ্যানুযায়ী, দফায় দফায় অভিযানে প্রায় তিন হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে ৭১ একর জায়গা।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/531244