১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১:৫৮

বিভাগ থেকে উপজেলা পর্যন্ত সক্রিয়

বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় পদচারণা আছে এসব গ্রুপের সদস্যদের। ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং এবং মাদক বিক্রির মতো অপরাধেও তারা জড়িত। খুন-ধর্ষণের ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। কিশোর গ্যাংয়ের কাছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি। এমনকি অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে কোনো কোনো কিশোর গ্যাং সদস্যের হাতে। এদের অনেকেই রাজনৈতিক ছায়ায় অবস্থান করে। আবার কেউ কেউ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুচর হিসেবে কাজ করছে। এ ধরনের গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

শহর-বন্দরে উঠতি বয়সের ছেলেরা একত্রিত হয়ে গ্যাং তৈরি করে নানা ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন নামে এলাকাভিত্তিক নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তুলেছে তারা। পাড়া-মহল্লায় নারীদের উত্ত্যক্ত, কটূক্তি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখানোসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক সেবন ছাড়াও নানা তুচ্ছ ঘটনায় গ্রুপে গ্রুপে চলছে হাতাহাতি-মারামারি। ঝুঁকিপূর্ণ বাইক ও কার রেসিং তাদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া আলোচিত-চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই ঘটেছে কিশোর অপরাধীদের মাধ্যমে।

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বন্ধে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। এ ঘটনার পর আমরা কিশোর গ্যাংয়ের একটি তালিকা করেছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ওই তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে। তিনি বলেন, কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে সেজন্য অভিভাবকদের বেশি সচেতন হতে হবে। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে সে বিষয়ে মা-বাবাকেই বেশি নজরদারি করতে হবে।

সূত্র জানায়, রাজধানীতেই ৬২টি কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব পেয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে ৪০টির বেশি গ্রুপ এ মুহূর্তে সক্রিয় আছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ জন। এদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। উত্তরা, ধানমণ্ডি, তেজগাঁও, কাফরুল, মোহাম্মদপুর, তুরাগ, নিউমার্কেট ও গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি। সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা সহস্রাধিক। চট্টগ্রাম মহানগরীতে অর্ধশত কিশোর গ্যাং দখলবাজি ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর নগর দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর অপরাধীদের নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। পুলিশি তৎপরতায় ওই সময় কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড অনেকটা কমে গিয়েছিল। সম্প্রতি মহানগরীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাং কালচার বেড়ে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সবুজবাগ থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য ইমনের (১৪) ছুরিকাঘাতে খুন হয় জব্বার আলী (১৫) নামের অপর কিশোর। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে তুচ্ছ ঘটনায় ইমনের ভাই ইয়াসিনের সঙ্গে জব্বারের কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এ ঘটনার জের ধরে ইমন তার পকেট থেকে ধারালো ছুরি বের করে জব্বারের পেটে ও পিঠে আঘাত করে। পরদিন সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জব্বারের মৃত্যু হয়। ২৭ আগস্ট সকালে উত্তরখানের খ্রিস্টানপাড়া ডাক্তার বাড়ি মোড় এলাকায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার চাকা থেকে পানি লাগে হৃদয় নামে এক কিশোরের গায়ে। হৃদয় ছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এ ঘটনা ঘিরে সোহাগ নামের এক যুবককে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তুচ্ছ ঘটনায় হাতাহাতির ঘটনার ৫ দিন পর রাজধানীর চকবাজারে নাদিম নামের এক যুবককে ৩০ আগস্ট প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ১৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ইস্পাহানি এলাকায় দুই কিশোর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় স্থানীয় দুই কিশোর ১৮ বছরের নিহাদ ও ১৫ বছরের জিসান শীতলক্ষ্যায় ঝাঁপ দিলে তাদের মৃত্যু ঘটে। ৩ আগস্ট সড়কে মারামারির ঘটনায় ‘টিকটক অপু’ নামে এক কিশোরকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। অপু একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। চট্টগ্রাম নগরীতেও সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বেশ কয়েকটি খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ ঘটনায় যারা আটক হয়েছে তদের বেশিরভাগই উঠতি বয়সী। অস্ত্র, ইয়াবাসহ ধরা পড়ছে কিশোর, যুবকরা। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে ও ১১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ১৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। মাত্র কয়েকদিন আগে আমি এ রেঞ্জে যোগ দিয়েছি। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলার এসপি ও থানার ওসিদের কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশ দিয়েছি। তালিকা পাওয়ার পরই এ বিষয়ে দ্রুত পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সামজিক স্থিরতার জন্য খুবই বিপজ্জনক। তাই গ্যাং কালচার বন্ধ করতে র‌্যাব সর্বদা সচেষ্ট। এরই মধ্যে বেশ কিছু অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্যকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

পুলিশের সদর দফতেরর এআইজি সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য রোধে কাজ করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম পুলিশের কাছে তথ্য আছে- সন্ধ্যার পর নগরীর স্টেশন রোড, বিআরটিসি মোড়, কদমতলী, চকবাজার, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশি, ফয়েস লেকসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসের পাড়া, ফরিদের পাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর, বন্দর কলোনি ও পতেঙ্গার বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক বেচাকেনাসহ মোটরসাইকেল ও সাইকেল ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ করে কিশোর গ্যাং। এছাড়া গান-বাজনা, খেলার মাঠ, ডান্স ও ডিজে পার্টি, ক্লাবের আড্ডাসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণে মরিয়া কিশোর গ্যাং চক্র। মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ ও মোবাইল ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ঘটনায় কিশোর অপরাধীরা জড়িত। নিজ এলাকার মধ্যেই এরা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কিশোর সন্ত্রাসীদের অধিকাংশই অপরিচিত মুখ। যে কারণে গ্রেফতার কিংবা আটকে সফল হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এ ব্যাপারে সিএমপির এডিসি (গণসংযোগ) মির্জা সায়েম মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘কিশোর অপরাধীদের গ্যাংয়ের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। নতুন কমিশনার স্যার এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। এদের ব্যাপারে এখন কাজ চলছে।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/344128