ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ-ড. জাহিদ হোসেন। ফাইল ছবি
২৭ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৬

সরকারের ব্যাংক ঋণ ও খেলাপি ঋণে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি

আর্থিক ব্যবস্থায় ঝুঁকির শঙ্কা

করোনার মধ্যে বিশেষ ছাড়ের সুযোগ পাওয়ার পরও ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো নতুন ঋণখেলাপি করা যাবে না- এমন নির্দেশনার পরও এপ্রিল থেকে জুন- এ ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এদিকে করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। ফলে চলতি ব্যয় মেটাতে সরকারকে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।


সরকারের ঋণে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, করোনার কারণে বিশ্ববাণিজ্য থমকে গেছে। এর সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মানুষের চলাচল স্তিমিত হয়ে গেছে। এতে আর্থিক লেনদেন কমে গেছে। ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। রাজস্ব আয় কমলেও সরকারের ব্যয় থেমে নেই। উল্টো করোনা ব্যবস্থাপনা সামাল দিতে সরকারকে আরও বেশি অর্থব্যয় করতে হচ্ছে। একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে।

এই দুইয়ের মাঝে সমন্বয় ঘটাতে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এছাড়া সরকারের হাতে কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের ব্যাংক ঋণ লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টেও এ ঋণ অনেক বেশি বেড়েছে। গত অর্থবছরের ঋণ বেশির ভাগই বেড়েছে করোনার শুরুর পর থেকে। অর্থাৎ মার্চ থেকে। তবে সরকার একটি কাজ ভালো করছে- বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমবে। বেসরকারি খাত ঋণ নিতে পারবে।

সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চলতি ব্যয় মেটালে অবশ্যই সরকারকে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে। কেননা সরকার ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলে আরও বেশি করে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থকে বলা হয় ‘হাইপাওয়ার্ড মানি’।

এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিকভাবে মিতব্যয়ী হতে হবে। যাতে ঋণের কোনো অর্থই অপচয় বা দুর্নীতি না হয়। যথাসম্ভব এসব অর্থে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি যাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে কাজে লাগে- সেদিকে নজর রাখতে হবে। ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে গেলে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে মূল্যস্ফীতির হারে চাপ কম পড়বে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে দেশের উৎপাদন খাত চাঙ্গা হবে।

তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় নিয়ে আসতে হলে ঋণ করে হোক বা বিকল্প কোনো উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। অর্থনীতির সব খাতেই টাকার জোগান দিতে হবে। এতে অর্থনীতির সব খাত চাঙ্গা হবে।


খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি একটি ক্যান্সারের মতো হয়ে গেছে। এই ক্যান্সার নিয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকা যায় না। আর্থিক খাত বাঁচাতে হলে ক্যান্সার ঠেকাতে হবে। করোনায় ব্যাংকগুলোকে এত বেশি চাপ দেয়া হল, তারপরও খেলাপি ঋণ বাড়ল কেন? এ প্রশ্ন সব মহল থেকেই উঠেছে। বলা হচ্ছে- ক্রেডিট কার্ডের ঋণখেলাপি হয়েছে, এ কারণে বেড়েছে। সেটি হয়ে থাকলেও খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নতুন করে ঋণখেলাপি হওয়া যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি আদায় বাড়াতে হবে। দুটোই একসঙ্গে করতে হবে। তা না হলে কাজে আসবে না।

বারবার ছাড় দিলে খেলাপির জোয়ার থামবে না: খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, নীতি সহায়তা দিয়ে বিভিন্ন সময় ঋণখেলাপিদের নানাভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়ন, নতুন করে ঋণখেলাপি না করাসহ আরও অনেক ধরনের সহায়তা দেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।

বিশেষ করে কোনো প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক দুর্যোগের পর ঋণখেলাপিদের এ ধরনের সুযোগ দেয়া হয়। ফলে ঋণখেলাপিরাও এ ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। তারা বারবার খেলাপি হন। আর এ ধরনের সুযোগ নেন। ঋণখেলাপিদের এ ধরনের সযোগ সরকারি ভাবেই করে দেয়া হচ্ছে। এ প্রবণতা বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণের জোয়ার থামানো সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত সরকার থেকে যে জিনিসকে সহায়তা করা হয় তা সব সময় বাড়ে। সরকার থেকে ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন সময় ছাড় দেয়ার কারণে তাই খেলাপি ঋণও বেড়ে যাচ্ছে। কেননা ঋণখেলাপিরা জানেন যখনই দেশে কোনো দুর্যোগ নেমে আসবে তারপরই তাদের জন্য বের হওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হবে। এ কারণে এ সুযোগ গ্রহণের জন্য অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই খেলাপি হন। পরে আবার সরকারের দেয়া ছাড়ের বিশেষ সুযোগ নিয়ে ঋণখেলাপির দুর্নাম থেকে মুক্ত হন।

খেলাপি ঋণের মতো আর্থিক খাতের দুষ্ট সংস্কৃতি থেকে বের হতে সরকারকে বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতির হ্রাস টানতে হলে আগে আদায় বাড়াতে হবে। এখন যে অবস্থায় আর্থিক খাত চলছে তাতে খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হবে না। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে আরও কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগে সরকার থেকে ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি সহায়তা করতে হবে। তা না হলে খেলাপি ঋণের যে অপ্রতিরোধ্য জোয়ার এসেছে আর্থিক খাতে তা কোনো ক্রমেই থামানো যাবে না।

করোনার মধ্যে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর বলেন, সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিভিন্ন কারণে ঋণ যত কম পরিমাণে নিতে পারে ততই দেশের জন্য ভালো। একই সঙ্গে এটা বেসরকারি বিনিয়োগের জন্যও ভালো। সরকার ব্যাংক ঋণ কম নিলে বেসরকারি খাত বেশি ঋণ পাবে। তখন অর্থনীতি আরও বেশি গতিশীল হবে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। যা সরকারকে করোনার প্রভাব মোকাবেলা করতে সহায়তা করবে।

রাজস্ব আয় বাড়াতে অপচয় কমাতে হবে: ড. জাহিদ হোসেন

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, করোনার প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে যাওয়ায় রাজস্ব আয় অনেক কমে গেছে। এতে সরকারকে ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হচ্ছে। এতে বেড়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ।

ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে এই অর্থনীতিবিদ জানান, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে বেসরকারি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। জিডিপিতে জোগানের বড় অংশই আসছে বেসরকারি খাত থেকে। ফলে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে হবে।

সরকারের ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা কমাতে তিনি দুটি সুপারিশ করেছেন। এর একটি হল রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং অপরটি হল অপচয় কমানো। রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনার কারণে যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে রাজস্ব আয় বাড়ানো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তারপরও এদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। আয় বাড়ানোর জন্য বৈদেশিক অনুদান ও ঋণের যেসব অর্থ পাইপলাইনে আটকে রয়েছে, সেগুলো ছাড়ের দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে সরকারের আর্থিক ব্যয়ের চাপে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে।

তিনি আরও বলেন, ব্যয় কমানোর অন্যতম একটি পথ হচ্ছে অপচয় কমানো। অপচয় কমানো সম্ভব হলে ব্যয় কমানোও সম্ভব। সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটিতে যাওয়ার (এলপিআর) পরও বিভিন্ন ভাতা দেয়া হয়। এগুলো কমানো যেতে পারে। সরকারি খাতে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। এগুলো কেনাকাটায় যেমন অপচয় হয়, তেমনি এগুলোর পরিচালন ব্যয়ও আছে। এ ধরনের আরও অনেক খরচ আছে, যা কমাতে পারলে অপচয় কমানো যাবে। এখন সরকারকে এদিকে নজর দেয়া উচিত। যদিও সরকার ইতোমধ্যে বিদেশভ্রমণ ও জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় নয়- এমন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

করোনার বিশেষ ছাড়ের মধ্যেও খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে থাকলে একসময় না একসময় বিস্ফোরণ ঘটবেই। এখন পর্যন্ত খেলাপি কমানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নিতে দেখছি না। এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না। আর খেলাপি ঋণ না কমলে অর্থিক খাত গতিশীল হবে না।

করোনার সময়ে খেলাপি ঋণে দেয়া বিশেষ ছাড়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নতুন করে ঋণ খেলাপি না করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থগিতাদেশ সেপ্টেম্বরের পর যেন আর কোনোক্রমেই বাড়ানো না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। ঋণের মান অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা না করলে খেলাপির চিত্র সামনের দিনগুলোয় আরও খারাপের দিকে যাবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/338715