২৭ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:৫১

বিলাসীবাড়ি, মোবাইল ফোন প্রকল্পের টাকায়

সমীক্ষা প্রকল্পে ২২টি মোবাইল ফোন ক্রয়; সোয়া ৫ কোটি টাকায় আবাসিক ভবন

রাষ্ট্রীয় ও ঋণের অর্থ দিয়ে বিলাসিতায় মেতে উঠেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। সোয়া ৫ কোটি টাকা খরচে বিলাসী ও ব্যয়বহুল বাড়ি (আবাসিক ভবন) নির্মাণ, ২২টি মোবাইল ফোন কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পে। প্রয়োজনের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত কেনাকাটার মাধ্যমে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। একনেক সভা থেকে প্রতিনিয়ত নির্দেশনা দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো। কোনো খাতে থোক বরাদ্দ না রাখার নিষেধাজ্ঞাও তারা মানছে না। ফলে প্রকল্প ব্যয়ে লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পৃথক দু’টি প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। দু’টি প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা আগামী ২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ভৌত অবকাঠামো বিভাগটির প্রস্তাবনার খরচের হিসাব পর্যালোচনা থেকে অস্বাভাবিক ও অবাক হওয়ার মতো দু’টি খরচে খাত পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও কার্যপত্রে কেনাকাটার পরিমাণ এবং গাড়ি ভাড়া খাতে এক কোটি ১৩ লাখ টাকা খরচের প্রস্তাবিত হিসাবে সম্মত হতে পারছে না বলে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ দিয়েছে এক হাজার ১১৩ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয়ে মধুপুর-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়ক (এন-৪০১) যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প প্রস্তাবনা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থ ব্যয়ে তিন বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৩৩.৪৭ কিলোমিটার মহাসড়কটির মান উন্নয়ন ও প্রশস্ত করা হবে বাড়তি ৪ দশমিক ৮ মিটার।

সড়ক উন্নয়নের এই প্রকল্পে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা খরচ করে আবাসিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে সম্প্রতি একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দু’টি বাংলোর নির্মাণকে বাতিল করেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আবাসিক ভবন নির্মাণ পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব খাতে ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে সুপারভিশন পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। সেখানে তাদের বিভিন্ন মেধার প্রকৌশলীই রয়েছে। ফলে এটার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের।

বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পের আওতায় যানবাহন ক্রয়ের ওপরও বিধি আরোপ রয়েছে। সেখানে ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২টি ডাবল কেবিন পিকআপ এবং ৪টি মোটরসাইকেল ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

অন্য দিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের দেয়া ঢাকা উত্তর সিটির করপোরেশনের জন্য ২৪ কোটি ২৮ লাখ ২১ হাজার টাকা ব্যয়ে করপোরেশন এলাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য এলাকাসমূহ নির্বাচন, ডিজাইন, ড্রইং, প্রাক্কলন করা। পাশাপাশি এলাকার জন্য পরিবেশগত ও সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রকল্পটি অনুমোদনের পর ১৬ মাস লাগবে বাস্তবায়নের জন্য।

প্রকল্পের আওতায় দেশী ও আন্তর্জাতিক মিলে ১৫ জন পরামর্শক ও ব্যক্তিগত ফার্ম ৫টি নিয়োগ দেয়া হবে। মাইক্রোবাস, জিপ ও কার মিলে ১২টি যানবাহন কেনা হবে। দেশী ও বিদেশী প্রশিক্ষণ, ফার্নিচার, অফিস সামগ্রী, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, স্ক্যানার ও প্রিন্টার মেশিন কেনা হবে।

প্রস্তাবনার ব্যয় বিভাজনে দেখা যায়, ৫৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়েছে ২২টি মোবাইল ফোন, ১৫টি কম্পিউটার, ৪টি ল্যাপটপ, ২টি ক্যামেরা, ৫টি স্ক্যানার ও ৩১টি লেজার প্রিন্টার মেশিন, ২টি টিভি স্ক্রিন, প্রজেক্টর। যা ডিপিপির ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় রয়েছে বলে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যাচাইয়ে ধরা পড়ে। এখানে ২২টি মোবাইল, ৩১টি লেজার প্রিন্টার নিয়ে কমিশনের প্রশ্ন। প্রকল্পের আওতায় সিনিয়র এক্সিউটিভ টেবিল ২১টি, সেক্রেটারিয়েট টেবিল কাঠের ৬টি, ইউটিলিটি টেবিল ৭টি, এক্সিটিউটিভ চেয়ার ২৭টি, ভিজিটিং চেয়ার ৬৮টি, ২ সেট সোফা, বুক সেলফ ৭টি, ৩৬টি স্টিল ফাইল কেবিনেট, ১৭টি আলমিরা, চেয়ার ৭টি ইত্যাদি খাতে ৪৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। গাড়ি ভাড়া খাতে ব্যয় হবে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। কিন্তু যানবাহন কেনা না হলেও এই খাতে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ধরা হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। বৈদেশিক প্রশিক্ষণে ৬৫ লাখ টাকা এবং দেশী প্রশিক্ষণে ৩৫ লাখ টাকা।

প্রকল্পের আওতায় পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এখানে ফার্মের সংখ্যা কমিয়ে ২/১টি ও পরামর্শকের পরিমাণ হ্রাস করা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করছে।

ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান বলছেন, সড়কের ডিপিপি খুবই দুর্বলভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। যথাযথভাবে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হবে। সড়কের নিজস্ব জনবল দিয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ওই সমীক্ষায় প্রকল্পটি ভায়াবল হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে প্রধান প্রদান সূচকগুলোয় তথ্য যথাযথভাবে প্রদান করা হয়নি। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পুনঃপর্যালোচনা করে এ সমস্ত তথ্যাদি প্রদান করা একান্ত আবশ্যক। আর প্রকল্প থেকে আবাসিক ভবন নির্মাণ ও ৬টি যানবাহন কেনার প্রস্তাব বাদ দিতে হবে। ফিস সরঞ্জামাদি ও কম্পিউটার-যন্ত্রাংশ কেনার প্রস্তাবও ডিপিতে বাদ দিতে হবে। অন্যান্য খাতের ব্যয়ের অঙ্ক যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে।

আবাসিক ভবন নির্মাণ ও ২২টি মোবাইল ফোন কেনার ব্যাপারে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) মিজ শামীমা নার্গিসের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, সামনে পিইসি মিটিং আছে। আমরা এই বিষয়গুলো দেখব। ডিপিপির প্রস্তাবনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করব। তিনি বলেন, ২২টি মোবাইল ফোন কেন কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে সেটার ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। আপনাদের কাছে যেটা বেশি মনে হচ্ছে পর্যালোচনায় দেখা যায় সেটার যৌক্তিকতা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, সমীক্ষা প্রকল্পে ২২টি মোবাইল ফোন, এত আলমিরা, ফাইল কেবিনেট কিসের প্রয়োজন, আমার মাথায় আসে না। যেখানে সরকারের রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে সেখানে এভাবে অর্থের অপচয় কেন। এসব খরচ ঘটনা ঘটার আগে বন্ধ করতে হবে। পাসের পর করলে কোনো কাজ হবে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও কমিশন চোখেও দেখে না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/524245