২৬ আগস্ট ২০২০, বুধবার, ৯:৩৪

ঘরবাড়ি ছাড়ছে উপকূলীয় মানুষ চুলা জ্বলছে না হাজারো পরিবারের

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির পানি বন্দী কয়েক হাজার মানুষের চুলা জ্বলছে না। তিন বেলা আহার ও জুটছে না তাদের। থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই। রাস্তাঘাট, চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমি সব পানিতে একাকার হয়ে গেছে। চারি দিকে পানি আর পানি। পা ফেলানোর ঠায় নেই। মানুষ গ্রাম ছাড়ছে প্রতিনিয়ত। সারা জীবনের রোজগার আর স্বপ্ন সবই নদীর জ্বলে একাকার। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অবস্থা আসহনীয়। যুবতি মেয়েদেরে দূরদূরান্তের আত্নীয় স্বজনদের বাড়িতে রেখে এসেছে পানি বনন্দিরা। আশাশুনি ও শ্যামনগরের ৬০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দী। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকে অধিকাংশ গ্রামে পানি থাকলেও সম্প্রতি জোয়ারের পানিতে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।

আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নূরুল আফসার বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভেঙে যাওয়া বাঁধ দিয়ে এলাকায় পানি ঢুকছে। আম্পানের পর রিং বাঁধ দেওয়ায় কয়েকটি গ্রামে পানি কিছুটা কমে গিয়েছিল। নতুন করে খোলপেটুয়া নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ছুটছে নতুন আশ্রায়ের খোঁজে। রাস্তা, ফসলি জমি কিংবা চিংড়ি ঘের আলাদা করে চিহ্নিত করার উপায় নেই। চারদিকে শুধু পানি আর পানি।

কোথায় যাব, কী খাব, এই দুরবস্থার শাহিন বলেন, ২০ মে আম্পানের পর বাড়ি-ঘর সব ধসে গেছে। উঁচু জায়গায় তাঁবু টানিয়ে ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে কোনো রকমে ছিলেন। সেটাও পানিতে তলিয়ে গেছে। পুরো ইউনিয়ন পানির নিচে। প্রতাপনগর ইউনিয়নের সাকিলা বিবি, আমেনাা খাতুন, আব্দুল মালেক সানাসহ অধিকাংশ মানুষের একই কথা। তাঁরা বলছেন, আগে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে জনপদ হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে তাদের ঠিকানা। প্রতাপনগর ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামের সব একাকার পানিতে। আলাদা করার কোনো উপায় নেই। ৩৬ হাজার বাসিন্দার সবাই কম-বেশি খোলপেটুয়া নদীর লবণ পানির হানায় ক্ষতিগ্রস্ত।

একই অবস্থা শ্রীউলা ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের।
প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘দুরবস্থার কথা কাকে বলব? আম্পানের আগে বাঁধ সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছিলাম। কোনো কাজ হয়নি। মানুষের দুরবস্থা দেখলে কান্না আসে। অথচ কিছু করতে পারছি না।’

শ্রীউলা ইউপির চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল বলেন, এমন দীর্ঘ সমস্যায় তাঁর ইউনিয়নের মানুষ কখনো পড়েনি। মানুষ গ্রাম ছেড়ে বাঁচার জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছে। পানিবাহী রোগে ভুগছে। কবে বাঁধ মেরামত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জোয়ারের পানি বেড়েছে ৫ থেকে ৬ ফুট। শ্যামনউপর আসনের সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলাম, স্থানীয় সংগঠনের সভাপতি প্রভাষক আব্দুল জলিল জানান, স্থায়ী টেকসই বেড়ি বাঁধ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক ভাবে বসবাস করা অসম্ভব। দ্রুত সরহারী বরাদ্দ বাস্তবায়ন করা। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চারপাশে নদী। প্রায় ৪৫ হাজার জনসংখ্যার বসবাস এখানে। বর্তমানে তাদের রাত কাটে পানি আতঙ্কে। চারপাশে সাগরের জোয়ারের নোনপানি।

কয়েক দশক বেড়িবাঁধের সংস্কার না করে যেখানে ভাঙন সেখানে যত্রতত্র পটি দেওয়া হচ্ছে মাত্র। কিন্তু বারবার গুছিয়ে ওঠা পরিবেশকে তছনছ করছে সিডর, আইলা, নার্গিস, ফনী, বুলবুল ও আম্পান নামের ঘুর্নিঝড়।

কর্তৃপক্ষের অবহেলার পাশাপাশি বেড়িবাঁধ ধ্বংসে কম দায়ী নয় স্থানীয় চিংড়ি চাষীরা। বেড়িবাঁধ নষ্ট করে ও সরকারী পানিসরবরাহের সুইজ গেট,খাল ও খাসজমিগুলো ব্যবহার করে প্রভাবশালী মহল। ১৯৯০ সালের পর থেকে শুরু করে গোটা উপকূলে লবণ পানির চিংড়ি চাষ। উপকূলবাসীর একান্ত দাবি ও দাবির যৌক্তিক কারণ দর্শাইয়ে দু’দশক ধরে কথিত জলবায়ু সহনশীল টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরী করার আবেদন করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, আমরা যা দেখছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সীমাহীন কষ্টের মধ্যে রয়েছে মানুষ। আম্পানের পর সরকার মানুষের কষ্ট লাঘবে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও অতি বর্ষণের কারণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পানি বন্ধ করতে এক হাজার মেট্রিকটন চাল বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ২৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামানো হয়েছিল।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিরসনে দুটি প্রকল্পে এক হাজার কোটির টাকার অধিক বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সামাগ্রিক বিষয় মনিটরিং করা হচ্ছে। তারপরও ব্যর্থতাগুলো কোথায় সেটি খুঁজে বের করে মানুষের দু:খ কষ্ট লাঘবে আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে।

https://dailysangram.com/post/425254