২৪ আগস্ট ২০২০, সোমবার, ১১:১১

৩ মাস ধরে জোয়ার-ভাটায় ভাসছেন কয়েক হাজার মানুষ

উপকূলে ফের ভাঙছে বেড়িবাঁধ

সুপার সাইক্লোন আম্পান আঘাত হানার ৩ মাস পার হলেও পানিবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পাননি উপকূলবাসী।

স্বেচ্ছাশ্রমে স্থানীয়দের দেয়া রিংবাঁধ ভেঙে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়ায় নতুন করে ভাঙছে বেড়িবাঁধ।

প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। সুপেয় পানি ও খাবার সংকটে অসহায় হয়ে পড়েছেন মানুষ। কিছু জায়গায় নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ধসে গেছে নদী তীর রক্ষা বাঁধসহ সেতু, পুল ও কালভার্ট। তলিয়ে গেছে হাজার-হাজার একর ফসলি জমি।

বিধ্বস্ত হয়েছে মাইলের পর মাইল সড়ক। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কাঁচা ঘর-বাড়ির। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। মরে গেছে হাঁস-মুরগিসহ গবাদিপশু। পানিবন্দি হয়ে আছেন প্রায় ৫ লাখ মানুষ। তাদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন এসব মানুষ। ত্রাণ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা।

কেউ কেউ ঘরবাড়ি ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে, ভয়াবহ ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা ও স্থানীয়দের সহায়-সম্বল। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, প্রতিদিন অস্বাভাবিক জোয়ার হচ্ছে। সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র পানিতে থইথই করছে।

মেঘনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঁদপুর ও হাইমচরের নদী তীরবর্তী ১৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার পরিবার চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। যুগান্তর ব্যুরো, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

খুলনা ও পাইকগাছা : আম্পানের আঘাতের ৯০ দিন পর আবার প্লাবিত হয়েছে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরা উপজেলার আশাশুনি উপজেলার অর্ধশত গ্রাম। অমাবস্যার প্রবল জোয়ার এবং সৃষ্ট নিুচাপে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পায়।

বৃহস্পতিবার কয়রার ৫টি স্থান নতুন করে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে পুরনো সব এলাকা। এতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কপোতাক্ষ আর কয়রা নদীর উচ্চ জোয়ারে কয়রার পাশাপাশি নদীর অপরপ্রান্তের আশাশুনি উপজেলার ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এদিকে কয়রা উপজেলায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ২নং কয়রা, গোবরা, ৩নং কয়রা ও বেদকাশি ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ এলাকা।

বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে ভেঙে যাওয়া স্থানগুলো আটকানোর চেষ্টা করলেও পানির চাপে আটকাতে ব্যর্থ হন। এর আগে বুধবার কয়রা উপজেলার কাজীপাড়া, পুটিহারী, হরিণখোলা, কাশিরহাট খোলা, ঘাটাখালি প্লাবিত হয়।

২০ মে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে খুলনার কয়রা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লোনা পানি প্রবেশ করে। এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে তিনটি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধে রিং বাঁধ দিয়ে আটকানো সম্ভব হলেও উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হাজতখালি বেড়িবাঁধের ভাঙন আটকানো সম্ভব হয়নি।

সেই থেকে দীর্ঘ ৩ মাস ধরে জোয়ার-ভাটায় ভাসছে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ।

তার ওপর গত কয়েকদিনের বৈরী আবহাওয়ায় নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়াতে লোনা পানির প্রবল চাপে ভেসে গেছে সমগ্র উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন। পাইকগাছার ৫টি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। শিবসা নদীর পানির তোড়ে পাউবোর

বাঁধ ভেঙে ও উপচে পড়া পানিতে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে গেছে। পাউবো উপ-প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দীন জানান, অর্থ সংকটের কারণে টেকসই বেড়িবাঁধ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

মনপুরা (ভোলা) : ভোলার মনপুরায় মেঘনার পানি বিপদসীমার উপর প্রবাহিত হয়। এতে মূল ভূ-খণ্ডে বাঁধ উপচে পানি প্রবাহিত হয়ে নিম্নাঞ্চলসহ মূল ভূখণ্ডে ৪-৫ ফুট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। ৩ দিনের জোয়ারের পানির তোড়ে ১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধসহ পাকা সড়ক বিধ্বস্ত হয়।

এখনও প্লাবিত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ডিভিশন-২ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবদুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের কার্যক্রম চলছে।

রামগতি (লক্ষ্মীপুর) : ভয়াবহ নদীভাঙন ও অস্বাভাবিক জোয়ারে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ; তাদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে।

এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পরিস্থিতির কারণে দুই উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি করছেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লাখো মানুষ। সোমবার সকালে নদী ভাঙন রোধ দাবি ও দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ করার কথা রয়েছে ‘কমলনগর রামগতি বাঁচাও মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠনের।

প্রতিদিনই দুই বেলা জোয়ার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে রামগতি ও কমলনগরের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবে থাকে। অভাব দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। জানা গেছে, ৫ আগস্ট একদিনের জোয়ারে মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কমলনগর উপজেলার ২১০টি পুকুরের ১ কোটি ১০ লাখ মাছ ও পোনা ভেসে গেছে।

এতে দুই উপজেলায় প্রায় ২ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে। কমলনগর উপজেলা প্রকৌশলী জানিয়েছেন, সড়ক বিচ্ছিন্ন ও সেতু কালভার্ট ধসে যাওয়ার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

বাগেরহাট : তলিয়ে গেছে সুন্দরবনের অন্যতম উঁচু পর্যটন স্থান চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলসহ দেশের একমাত্র হরিণ, কুমির ও বাটারগুল বাচকা কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্রটিতে থাকা বন্যপ্রাণীর সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে পানি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যা থেকে রক্ষা পায়নি কুমিরের ডিম তা দেয়ার জন্য উঁচু মাটির একাধিক কেল্লা। কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে করমজল প্রজনন কেন্দ্রর ট্যাংকগুলো।

সুন্দরবনের অভ্যন্তরে কুমিরের ডিম পাড়া প্রাকৃতিকভাবে মাটির কেল্লাগুলো ডুবে যাওয়ায় এবার প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবনে ডিম থেকে বাচ্চা বৃদ্ধির বিষয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

চাঁদপুর : মেঘনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঁদপুর ও হাইমচরের নদী তীরবর্তী ১৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার পরিবার চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। চলতি সপ্তাহজুড়ে জোয়ারের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় চাঁদপুর সদর ও হাইমচরে বসতবাড়ি, মৎস্য খামার, ফসল ও সড়কের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।

জানা গেছে, গত দু’দিন ধরে চাঁদপুরে থেমে থেমে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে।

জোয়ারের পানিতে চাঁদপুর শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক, রহমতপুর আবাসিক এলাকা, ট্রাক রোড, নাজিরপাড়াসহ নিু এলাকাগুলোর সড়কের অবস্থা খুবই করুণ। এদিকে হাইমচর উপজেলার মেঘনার পূর্ব পাড়ের নদী তীরবর্তী এলাকায় জোয়ারের পানিতে ফসল, সড়ক ও বসতবাড়ির ক্ষতি হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/337744