র‌্যাব হেফাজতে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ
২৪ আগস্ট ২০২০, সোমবার, ১১:০৮

গুলী করে চিকিৎসা ছাড়াই ৫৫ মিনিট ফেলে রাখা হয় সিনহাকে

নাছির উদ্দিন শোয়েব : মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডে স্বীকারোক্তি দিতে চাচ্ছেন না টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত ও নন্দদুলাল রক্ষিতের সাত দিনের রিমান্ড শেষ হচ্ছে আজ সোমবার। আগামিকাল মঙ্গলবার তাদেরকে আদালতে হাজির করা হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বীকারোক্তি না দিতে চাইলে ফের রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানা গেছে। কমিটি এখন পর্যন্ত ৬৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। রিমান্ড শেষে প্রদীপের সাক্ষ্য নিবে তারা। র‌্যাবের তদন্ত এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রায় কাছাকাছি সময়েই শেষ হচ্ছে বলে জানা গেছে। একটি সূত্র জানায়, গুলী করার পর পানি ও অক্সিজেন চান সিনহা। তাকে তা দেওয়া হয়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে তথ্য রয়েছে, চিকিৎসা ছাড়া ৫৫ মিনিট তাকে রাখা হয়েছিল। তবে প্রদীপ দাবি করছেন, গাড়ি আসার পর পরই সিনহাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

চাঞ্চল্যকর মেজর (অব.) সিনহা হত্যায় এখন পর্যন্ত ১০ পুলিশ সদস্যসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে তদন্ত সংস্থ্ ার‌্যাপিড আ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এরমধ্যে তিনজন সিভিল নাগরিক, যারা পুলিশের করা মামলার সাক্ষী। চার পুলিশ ও তিন সাক্ষীর রিমান্ড শেষ হয়েছে। তারা এখন কারাগারে। প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দ দুুলাল এবং এপিবিএনের তিন সদস্য এখনো র‌্যাব হেফাজতে আছেন। সূত্র জানায়, আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। তবে কি কারণে, কেন মেজর সিনহাকে গুলী করা হলো এ বিষয়টি এখনো তিন আসামির কাছ থেকে স্পষ্ট হওয়া যায়নি। নন্দদুলাল র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, লিয়াকত এবং তিনি সাদা পোশাকে এপিবিএন এর চেক পোষ্টে যান সেই রাতে। নন্দ দুলালের মোটরসাইকেলে করেই লিয়াকত ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। এমনকি লিয়াকত নিজের অস্ত্রটি ব্যবহার না করে নন্দদুলালের অস্ত্র দিয়েই সেদিন সিনহাকে গুলী চালায় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন নন্দদুলাল। কিন্তু এ তথ্যের সঙ্গে প্রদীপ ও লিয়াকতের দেয়া তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি কোন পরিস্থিতিতে লিয়াকত গুলী ছুঁড়লেন বা এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে এমন কী হলো যে গুলী করে সিনহাকে হত্যা করতে হলো এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অস্পষ্ট।

সূত্র জানায়, প্রদীপ কুমার জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে পুরোপুরি নিরপরাধ দাবি করছেন। তিনি বলছেন, গুলী করার আগে লিয়াকতের সঙ্গে তার কথাই হয়নি। অন্যদিকে লিয়াকত বলছেন, তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে তিনি গুলী ছুঁড়েছেন। নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করে গুলী ছুঁেড়ছেন। কিন্তু এখনো তার কথায় গড়মিল পাওয়া যাচ্ছে। তবে নন্দ দুলাল সেদিনের গুলী বর্ষণের ঘটনার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই লিয়াকতের অস্ত্রটির রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য এনেছে র‌্যাব। এদিকে সেই রাতে সিনহাকে গুলী করার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে। তদন্ত সূত্র জানায়, কোন পরিস্থিতিতে কী কারণে সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলী করা হয়েছিল তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। এটা কী পরিকল্পিত নাকি তাৎক্ষণিক হত্যা, সেটা নিয়েও চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হচ্ছে। সিনহার নিহতের ঘটনায় করা মামলায় এখন তিন প্রধান আসামি সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব। লিয়াকতের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন চেকপোস্টে গুলী করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো? জবাবে লিয়াকত দাবি করেছেন, তিন সোর্স তাকে জানিয়েছেন, যারা গাড়িতে আসছেন তারা ডাকাত। এটা বিশ্বাসও করেছিলেন তিনি। ঘটনার সময় নিজেকে অনিরাপদ মনে করেন লিয়াকত। এ কারণে আগেই গুলী ছুঁড়ে দেন। পরে বুঝতে পারে সোর্স তাকে মিসগাইড করেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তিন সোর্স নুরুল আমিন, মো. নাজিমুদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, ঘটনার দিন রাত ৯টা ২৯ মিনিটের দিকে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এরপর লিয়াকত ফোন করেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। ১০টা ৫ মিনিটের দিকে প্রদীপ ঘটনাস্থলে আসেন। এরপর বিভিন্ন জনের কাছে ফোন করেন। তবে র‌্যাবের অনুসন্ধানে গুলির আগে লিয়াকতের ফোনালাপের কোনো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

মাদক মামলা তদন্তে ঘটনাস্থলে র‌্যাব: অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদের সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে করা মাদক মামলা তদন্তে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে র‌্যাবের তদন্ত দল। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে র‌্যাবের তদন্ত দল ঘটনাস্থল নিলিমা রিসোর্ট পরিদর্শনে যান। সেখানে সিনহা ও তার সহকর্মীদের ব্যবহৃত রুম পরিদর্শন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তকারী কর্মকর্তা বিমান চন্দ্র কর্মকার জানান, এই রিসোর্ট থেকে পুলিশের জব্দ করা আলামত ও ডিভাইস সমূহের পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ চলছে এবং মাদক মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থল পরিদর্শন বলে জানান তিনি। এরআগে গত ৩১ জুলাই সিনহাকে নিহতের পর এই রিসোর্টে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযান চালিয়ে মদ উদ্ধার দেখিয়ে শিপ্রার নামে মাদক মামলা করে পুলিশ।

অবৈধ সম্পদ অর্জন, ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা: টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রোববার দুপুরে দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়-১ এর সমন্বিত আদালতে এ মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন। দুদকের এ কর্মকর্তা জানান, প্রায় ৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে বরখাস্তকৃত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে মামলা হয়। প্রদীপের সম্পদ অনুসন্ধান এবং প্রাথমিক তদন্তে দুদকের কেন্দ্রীয় অনুমোদনের পর এ মামলাটি করা হয়েছে। দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সাল থেকে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাব দাখিলের জন্য নোটিশ করা হলে একই বছরের জুন মাসে তারা সম্পদের হিসাব দাখিল করেন।

এই সম্পদ বিবরণীর আলোকে দীর্ঘ অনুসন্ধানে প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রায় ৪ কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক। ১৯৯৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে এসআই পদে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই মূলত ওসি প্রদীপ অবৈধ সম্পদ অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। তার সম্পদ দৃশ্যমান হতে থাকে ২০০২ সাল থেকে। দুদক সূত্র জানায়, ওসি প্রদীপের সব সম্পত্তিই তার স্ত্রী চুমকি কারণের নামে। যার কোনো বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞাত আয়ের উৎসই নেই।

চুমকি কারণের নামে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৮৬৯ টাকার সম্পদ থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে তিনি পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে খরচ করেছেন ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। চুমকি কারণের পূর্বের সঞ্চয়, উপহার, বাড়িভাড়া থেকে বৈধ আয় হিসেবে ৪৯ লাখ ১৩ হাজার ২৩৪ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। বৈধ আয় বাদ দিলে চুমকির নামে মোট তিন কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। এটা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে সম্পদ ক্রয় করে স্ত্রীর নামে রেখেছেন বলে দুদক অনুসন্ধানে তথ্য পেয়েছে।

ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের মানবপাচার বাণিজ্য: এদিকে স্থানীয় সূত্র জানায়, টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও ছিলেন, ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ স্থানীয় পুলিশের কিছু সদস্য। জনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে নিয়ে নির্বিঘ্নে যেতে দিতেন যাত্রীবোঝাই নৌকা। মানবপাচার রোধে অভিযান চললে, শুরু হতো আরেক বাণিজ্য। হুমকি-ধমকি দিয়ে আদায় করতো, লাখ লাখ টাকা। টেকনাফের নোয়াখালীপাড়া ঘাট। কক্সবাজার থেকে নাফ নদী ও সাগরপথে মানবপাচারের তেত্রিশটি ঘাটের অন্যতম এটি। অনুসন্ধান বলছে, দালালদের পাশাপাশি এই কার্যক্রমে জড়িত পুলিশের কেউ কেউ। তার অন্যতম, সিনহা রাশেদ হত্যার প্রধান আসামি, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলী। নৌকার মাঝিরা জানান, উপকূল থেকে ছোট নৌকায় যাত্রীদের তুলে দেয়া হয় সাগরে অবস্থান করা বড় নৌযানে। এজন্য জনপ্রতি দুই হাজার টাকা যায় পুলিশের পকেটে আর এক হাজার করে পান নৌকার মালিক-মাঝি।

মানবপাচার রোধে অভিযান চললে শুরু হয় নতুন বাণিজ্য। নৌকা, জাল পুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি কথিত বন্দুকযুদ্ধের হুমকি দিয়ে আদায় হয় লাখ লাখ টাকা। অভিযোগ, দাবি করা ৫ লাখ টাকা না পেয়ে গত এপ্রিলে বন্দুকযুদ্ধে মারা হয় নোয়াখালী পাড়ার আবদুস সালাম মাঝিকে। ভেঙ্গে দেয়া হয় তার বাড়ি। এ ঘটনায়ও অভিযোগ লিয়াকত আর টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে।

উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাত ১০টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় নিহতের বোন শাহরিয়ার শারমিন ফেরদৌস বাদী হয়ে গত ৫ আগস্ট টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে র‌্যাবকে। এ ঘটনায় টেকনাফ থানার এ ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। এ মামলায় বর্তমানে তিনি রিমান্ডে আছেন।

https://dailysangram.com/post/425075