২৩ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ১:৩৭

অস্বাভাবিক জোয়ারে উপকূলবাসীর চরম দুর্ভোগ

অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ভেসে গেছে অসংখ্য মৎস্য ঘেরের মাছ। নষ্ট হয়েছে চাষীদের সবজি ক্ষেত। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মৎস্য ও সবজিচাষীরা। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।


হাটবাজার তলিয়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। হাঁটুপানি জমে রয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনায়। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন দিন এনে দিনে খাওয়া অসহায় মানুষগুলো। তাদের সাহায্যের জন্য কেউ হাত বাড়িয়ে দেয়নি।

ফেরিঘাটের পন্টুন ও রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় ফেরি ভিড়তে ও যানবাহন চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। অবিরাম বর্ষণ আর জোয়ার-ভাটার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নবনির্মিত অধিকাংশ রাস্তা। এতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মানুষের চলাফেরা। নোয়াখালীর হাতিয়ায় ১২ ফুট উচ্চতায় জোয়ারে ৫০

হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে সাতক্ষীরার ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মোংলা সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত বহাল রয়েছে। এতে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

যুগান্তর ব্যুরো, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চরফ্যাশন (ভোলা) : মেঘনা, তেঁতুলিয়া নদীর ফুঁসে উঠা জোয়ারের পানি খুব সহজেই ভেতরে ঢুকে তলিয়ে গেছে কুকরি-মুকরির ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পানিতে চারিদিকে থইথই করছে। কুকরি-মুকরি ইউনিয়ন বেড়িবাঁধে মেঘনা তেঁতুলিয়া নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালের ওপর বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধের দশটি পয়েন্টে স্লুইসগেট না থাকায় খুব সহজেই উজানের পানি ঢুকে প্লাবিত হয় পুরো কুকরি-মুকরি ইউনিয়ন।

নোয়াখালী : হাতিয়ায় ১২ ফুট উচ্চতার জোয়ার হয়েছে। কোথাও বেড়িবাঁধ ভেঙে কোথাও বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে পানি ঢুকে হাতিয়ার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। যার ফলে ৪ দিন ধরে ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, ৭০ সালের পর এ এলাকার মানুষ কখনও ১২ ফুট উচ্চতার জোয়ার দেখেননি। তিনি জানান, বিভিন্ন স্থানে বেড়ির ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ও বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে হাতিয়ার ১০টি ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়। সরকার ইতোমধ্যে পানিবন্দি মানুষের জন্য ৪০ টন জিআর চাল বরাদ্দ করেছেন বলে জেলা প্রশাসক অফিস থেকে জানিয়েছেন।


কাউখালী (পিরোজপুর) : কাউখালী উপজেলার নদী তীরের গ্রামগুলো ডুবে গেছে। উপজেলার পানি রক্ষা বাঁধ ভেঙে ও পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে ফসলি জমি ও বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৩০টির অধিক গ্রামের মানুষ।

মোংলা (বাগেরহাট) : মোংলা ও সুন্দরবন উপকূলীয় নদ-নদী ও খালে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়ায় ফেরিঘাটের পন্টুন ও রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় ফেরি ভিড়তে ও যানবাহন চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। জোয়ারের সময় ঝুঁকি নিয়ে চলছে ফেরি ও যানবাহন। উপজেলার কানাইনগর এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদ্য নির্মিত বেড়ি বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে তিনটি গ্রাম। এছাড়া পশুর নদীর জোয়ারের প্লাবন ছুয়েছে চাঁদপাই, চিলা, বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের আরও ১০টি গ্রাম। আবহাওয়া অফিস বলছে, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি এবং লঘুচাপের প্রভাবে মোংলাসহ আশপাশের উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।

বরগুনা ও তালতলী : বরগুনা জেলা শহরসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাথরঘাটার পদ্মা, বরগুনা সদরের গুলশাখালী, পাতাকাটা, মাঝের চর বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। প্রবল জোয়ারে ফেরির পল্টুন ডুবে যাওয়া বিষখালী নদীতে ফেরি চলাচল ৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে। এদিকে খাকদোন নদীর তীরবর্তী আবাসন এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় পোটকাখালী, কুমরাখালী, বদনীখালী সহস্রাধিক পরিবার চরম দুর্ভোগে পড়েছে। জেলার ৩ শতাধিক মাছের ঘের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় চাষ করা মাছ ভেসে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়ছার আলম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জোয়ারের পানি বরগুনার নদীগুলোর বিপদ সীমার ৪৫ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বাগেরহাট ও চিতলমারী : বাগেরহাটে জেলার ৭টি উপজেলার শতাধিক গ্রাম তিন থেকে চার ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে ভেঁসে গেছে বাগেরহাট সদর, মোংলা, রামপাল, মোরেলগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলায় দেড় হাজার চিংড়ি ও মৎস্য খামার। এসব গ্রামের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বেড়েছে তিন থেকে চার ফুট। এদিকে দিনে দু’বার ডুবছে বাগেরহাটের শরণখোলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারী ছয় গ্রামের প্রায় ৬০০ পরিবার। চিতলমারীতে জোয়ারের পানিতে নতুন করে আরওও বহু মৎস্য ঘের, সবজি ক্ষেতসহ অনেক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেকের বাড়িঘরে পানি উঠেছে।

পাইকগাছা (খুলনা) : খুলনার পাইকগাছার গড়ইখালী আবাসন ও আশ্রয়ণ কেন্দ্রের দেড়শ’ পরিবার অমাবস্যার জোয়ারের পানিতে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে অভিভাবকরা আতঙ্কে বসবাস করছে। উপজেলার গড়ইখালী বাজারের নদীর তীরে আবাসন ও আশ্রয়ন কেন্দ্র গড়ে উঠে। যেখানে দেড়শ’ পরিবারের ৭ শতাধিক লোক ২০০২ সাল থেকে বসবাস করছেন।

সাতক্ষীরা : জোয়ারের পানি ও বৃষ্টিতে কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর পানি ৩ থেকে ৪ ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়নের ২২টি গ্রাম ও প্রতাপনগরের ১৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে কপোতাক্ষর জোয়ারের চাপে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের অন্তত ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত গ্রামগুলোতে প্রায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব গ্রামের কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে।

ঝালকাঠি : ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ৫০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানি ঢুকে পড়েছে বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনায়। শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় পানি ভেঙে যাতায়াত করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় জেলার নদী তীরের বাসিন্দারা উঁচুস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় কাঁঠালিয়ার আমুয়া ও নলছিটির ষাইটপাকিয়া ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে তলিয়ে যান চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, স্বাভাবিকের চেয়ে সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে চার-পাঁচ ফুট পানি বেড়েছে। বিপদসীমার ৩৫ সেমি. উপর দিয়ে এসব নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

উজিরপুর (বরিশাল) : উজিরপুরে জোয়ারের পানিতে পৌরসভাসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ব্যাপক ক্ষতির মুখে রয়েছেন মৎস্যচাষীরা। সন্ধ্যা নদীর কোল ঘেঁষে থাকায় ও নিম্নাঞ্চল হওয়ায় প্রবল জোয়ারের পানি ঘরে ঢুকে আসবাবপত্র তলিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন পানিবন্দি মানুষ। এ অঞ্চলে নেই কোনো বেড়িবাঁধ ও স্লুইসগেট।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/337408