২৩ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ১:১৩

সিনহাকে গুলী করা অস্ত্রটি কার?

নাছির উদ্দিন শোয়েব: পুলিশের গুলীতে মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডের ঘটনায় বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। রিমান্ডে থাকা সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত ও নন্দদুলাল রক্ষিতসহ আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিদিনই নতুন তথ্য পাচ্ছে তদন্ত সংস্থা র‌্যাব। মেজর (অব.) সিনহাকে যে অস্ত্রটি দিয়ে সেই রাতে গুলী চালানো হয়েছিল সেই অস্ত্রটি আসলে কার, এ তথ্য এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি র‌্যাব। র‌্যাব বলছে, পুলিশের তথ্যে গড়মিল পাওয়া যাচ্ছে। বলা হয়েছিল পরিদর্শক লিয়াকত তার নিজের অস্ত্র দিয়ে সিনহাকে গুলী করেছে, অথচ রিমান্ডের অপর এক আসামী বলছে, তার অস্ত্রটি নিয়ে লিয়াকত গুলী চালিয়েছে। এসব বিষয় নিশ্চিত হতে ওই অস্ত্রের রাসায়নিক পরীক্ষা করে আসামীদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে র‌্যাব। অন্যদিকে মেজর (অব.) সিনহাকে বাহারছড়া চেক পোস্টে পুলিশের সিগন্যাল অমান্য করার কথা বলা হলেও ভিডিও ফুটেজে এর সত্যতা মেলেনি। সেই রাতের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ এবং পত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেদিন অতর্কিত গুলী চালানোর তথ্য রয়েছে র‌্যাবের কাছে। এছাড়াও গুলী করার আগে পুলিশ তাকে দুই মিনিটও সময়ও দেয়নি এমন ভয়ঙ্কার তথ্য এখন পুঙ্খানুপঙ্খভাবে যাচাই করছে র‌্যাব। এছাড়া গতকাল শনিবার সকালে এই মামলায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কারাগার থেকে বের করার পর আসামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যা তদন্তে বড় ধরনের অগ্রগতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। মূলত এখন পর্যন্ত দুটি অগ্রগতির খবর পাওয়া গিয়েছে। এরমধ্যে প্রথমটি হল সিনহার ওপর যে অস্ত্র দিয়ে গুলী করা হয়েছে সেটা কার? তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই মামলার অন্যতম আসামী এবং পুলিশের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নন্দ দুলাল দাবি করেছেন ইনস্পেক্টর লিয়াকত তার অস্ত্রটি নিয়ে সিনহার ওপর ৪টি গুলী করেছেন। লিয়াকত তার নিজের অস্ত্র দিয়ে গুলী করেননি। তবে নিয়ম অনুযায়ী যার জন্য অস্ত্র বরাদ্দ তিনি সেটা দিয়ে গুলী করতে পারেন। এই ব্যত্যয়টি ৩১ জুলাই পুলিশের অভিযানে হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র এএসপি খাইরুল ইসলাম বিকালে পুলিশ লাইন্সে যান। সেই অস্ত্রটি এরইমধ্যে সংগ্রহ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এএসপি খাইরুল ইসলাম বলেন, আমাদের উদ্দেশ্যই একটাই, আমরা যেসব তথ্য পাচ্ছি সেগুলো মিলিয়ে সঠিক তথ্য প্রমাণ খুঁজে দিতে পারি। এছাড়া আরেকটি অগ্রগতি হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় কারাগারে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে র‌্যাব হেফাজতে সাত দিনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়েছে। র‌্যাবকে তারা যে তথ্য দিয়েছে তা সত্য কিনা জানার জন্যই তাদের আজ মুখোমুখি করা হবে। পুলিশের দাবি সংকেত অমান্য, সিসিটিভির ফুটেজে স্যালুট: পুলিশের এজহারে বলা হয়েছে, এপিবিএনের সংকেত অমান্য করে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিলেন সিনহা রাশেদ। এরই ধারাবাহিকতায় নিহত হন সেনাবাহিনীর সাবেক এই মেজর। কিন্তু সিসিটিভির ফুটেজ বলছে, এই দাবি যে ভিত্তিহীন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা বিজিবির শিলখালী চেকপোস্টে আসেন ৩১ জুলাই রাত ৯ টা ২২ মিনিটে।

বিজিবি সূত্র বলছে, চেকপোষ্টে সিনহা তার স্বভাবজাত ব্যবহারের অংশ হিসেবে বিজিবি সদস্যদের সব প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করেন। তারপর শামলাপুর এপিবিএনের চেকপোস্টের দিকে স্বাভাবিক গতিতে চলে যায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ব্যক্তিগত গাড়ি। এর ঠিক ৩১ মিনিট পর ৯টা ৫৫ মিনিটে, অর্থাৎ শামলাপুরে পরিদর্শক লিয়াকতের গুলীতে সিনহার লুটিয়ে পড়ার ২৫ মিনিট পর প্রথমে একটি মাইক্রোবাস এবং পরে পুলিশের একটি পিকআপ বিজিবি শিলখালী চেকপোস্ট অতিক্রম করে।
র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিনহা শামলাপুর চেকপোষ্টে এপিবিএনের থামার সংকেত না মেনে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যাওয়ার যে দাবি করা হয়েছে পুলিশের এজাহারে, বিজিবির চেকপোস্টে সিসিটিভির ফুটেজ তা ভিত্তিহীন প্রমাণ করে।

৩ এপিবিএন সদস্য রিমান্ডে: অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় কারাগারে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের তিন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সাত দিনের জন্য হেফাজতে নিয়েছে র‌্যাব। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি খাইরুল ইসলাম জানান, গতকাল বেলা পৌনে ১২টার দিকে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়। তারপর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। বুধবার কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ শুনানি শেষে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন। তিন সদস্য হলেন এএসআই শাহজাহান, কনস্টেবল রাজীব ও আব্দুল্লাহ। সিনহাকে গুলি করার সময় তারা শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

অন্যদিকে টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহতের ঘটনার পর পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় বইছে। এরই মধ্যে চাঁদাবাজি, হত্যা, নির্যাতন, ক্রসফায়ারসহ নানা অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে। সিনহা হত্যাকাণ্ডসহ পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও মামলা ‘বিব্রতকর’ মনে করছেন পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। হঠাৎ পুলিশের বিরুদ্ধে এহেন চেষ্টায় ‘ভিন্ন উদ্দেশ্য’ও দেখছেন তারা।

পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যক্তি পুলিশের দায় কখনও বাহিনী নেবে না। বাহিনীর যেকোনো সদস্য অপরাধী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি হবে অপরাধী হিসেবেই। গড়পড়তা সমালোচনা, পুলিশবিরোধী বিষোদগার কিংবা হঠাৎ নানা অভিযোগে মামলার ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর নানামুখী সমালোচনা ও মামলার মধ্যে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ‘সেনাবাহিনী ও পুলিশ এ দুটি ঐতিহ্যবাহী ও ভ্রাতৃপ্রতিম বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চলছে।’

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনবান্ধব ও গণমুখী পুলিশ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা ও উৎসাহ অব্যাহত রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনটি।

অন্যদিকে মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুঃখজনক উল্লেখ করে ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ সমিতি। তবে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু কিছু প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে ব্যবহার করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালিয়ে আইনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তৎপর বলে মনে করছে সংগঠনটি।

উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই ঈদুল আযহার আগের দিন রাত ১০টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান (৩৬)। এ ঘটনায় নিহতের বোন শাহরিয়ার শারমিন ফেরদৌস বাদী হয়ে গত ৫ আগস্ট টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়েছে র‌্যাবকে।

https://dailysangram.com/post/424964