২৩ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ১:১০

বাংলা ভারত বৈঠকে নাগরিক পঞ্জি নাগরিকত্ব আইন ও তিস্তা উত্থাপিত হয়নি -ভারতীয় মুখপাত্র

আসিফ আরসালান : ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধণ শ্রিংলার ঢাকায় আকস্মিক ঝটিকা সফর সফল নাকি ব্যর্থ, এই প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ মিঃ শ্রিংলা তো নিজ থেকে ঢাকায় আসেননি। তাঁকে ভারত সরকার, সোজা কথায় প্রধানমন্ত্রী, কেন হঠাৎ করে ২৪ ঘন্টার জন্য ঢাকা পাঠালেন, সেই কারণটি অর্থাৎ মূল উদ্দেশ্যটি না জানলে সফরের সাফল্য বা ব্যর্থতার মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কেন তাকে এভাবে তড়িঘড়ি করে ঢাকায় পাঠানো হলো সে ব্যাপারে ঢাকা এবং দিল্লী উভয়েই টাইট লিপ্ড অর্থাৎ ঠোঁট সেলাই করে আছেন।

তাঁর ২৪ ঘন্টার ঢাকা সফর যেমন নাটকীয়, প্রস্থানও তেমন নাটকীয়। সোমবার ঢাকার এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকার খবরে জানা গেলো যে পরের দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব মিঃ হর্ষবর্ধণ শ্রিংলা এক সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা আসছেন। সেই সফরের কোনো এজেন্ডা নাই। কয়েকটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে তিনি দুই দিনের সফরে ঢাকা এসেছিলেন। এটা সঠিক নয়। তিনি ১৮ আগস্ট মঙ্গলবার একটি স্পেশাল ফ্লাইটে ঢাকা আসেন। পরদিন বুধবার বিকেলে ঐ একই বিমানে, অর্থাৎ স্পেশাল ফ্লাইটে তিনি দিল্লী ফিরে যান।

তাঁর এই সফর নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে। ১৮ তারিখ বেলা সাড়ে ১১ টায় তাঁর বিশেষ বিমান যখন ঢাকা অবতরণ করে তখন তাঁকে রিসিভ করার জন্য বাংলাদেশের তরফ থেকে কেউ ছিলেন না। ছিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলী। ১৯ আগস্ট এই খবরটি ছাপা হয়েছে ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজে’। ১৯ আগস্ট নিউ এজ এব্যাপারে প্রথম পৃষ্ঠায় যে রিপোর্ট করেছে, তার অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করছি। রিপোর্টে বলা হয়, “হোস্টেলে প্রায় ৫ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সাক্ষাৎ দান করেন। এক ঘন্টার বেশি সময় এই বৈঠক চলে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন প্রধানত শ্রোতা। ইংরেজিতে বলা হয়, “she has mostly lent her ear.”

নিউ এজের ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে হর্ষবর্ধণ শ্রিংলার সময় ধার্য করা ছিলো বেলা ৩-৩০ মিনিটে। সেই মোতাবেক তিনি কতিপয় নির্ধারিত বুদ্ধিজীবী এবং কয়েকজন নির্বাচিত সাংবাদিককে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ব্রিফিং দেবেন বলে কথা ছিলো। কিন্তু মিঃ শ্রিংলাকে বৈঠকে বসার জন্য সাড়ে ৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। সে কারণে নির্বাচিত বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের সাথে তার সাড়ে ৭টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তবে এসবের ফাঁকে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিক আহমদ সোবহান, তাঁর পুত্র, তাঁর মালিকানাধীন দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ সম্পাদক নঈম নিজাম, ৭১ টেলিভিশনের মালিক মোজাম্মেল বাবু, সাবেক তথ্যমন্ত্রী এবং জাসদের এক অংশের নেতা হাসানুল হক ইনু প্রমুখ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন।

রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র দফতর ঠিক করেন শেখ হাসিনা এবং শ্রিংলার মধ্যে বৈঠক ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। সুতরাং ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবকে তাঁর হোটেল কক্ষে অপেক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ডাক পাওয়ার পর মিঃ শ্রিংলা সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গণভবনের উদ্দেশে রওয়ানা হন। অতঃপর রাত ৮টায় বৈঠক শুরু হয় এবং সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বৈঠক চলে।

এই বৈঠক এবং সফর ভারতীয় পক্ষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে। ভারতের এক শ্রেণীর মিডিয়া ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে। সেই বিষয়টি আলোচনায় আসবে বলে মনে হয়। নিউ এজের রিপোর্টে আরো বলা হয় যে সাম্প্রতিককালে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আগের চেয়েও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। পাকিস্তানও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। এই লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। এই আলোচনায় ইমরান খান কাশ্মীর বিরোধ উত্থাপন করেন। তিনি বলেন যে উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্য কাশ্মীর বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন বাংলাদেশ কাশ্মীরকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে। পাকিস্তানের এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকান্তরে মন্তব্য করা হয়েছে যে কাশ্মীর ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারতকে অকুন্ঠ সমর্থন দেওয়ার পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো সুযোগ আছে বলে তারা মনে করেন না।

॥ দুই ॥
মিঃ শ্রিংলার সফরের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশন একটি প্রেস রিলিজ ইস্যু করে বলে নিউ এজের ঐ সংবাদে বলা হয়। ঐ প্রেস রিলিজে বলা হয়, ভারতের তিনটি স্তরের ওয়েব পোর্টাল অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও কয়েকজন মন্ত্রীসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ডিগনিটারী এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। ডেপুটি হাই কমিশন এই অপপ্রাচারের তীব্র নিন্দা করেছে। ডেপুটি হাই কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয় যে তিনটি ওয়েব পোর্টাল একজন বিকৃত সাংবাদিকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এই ব্যক্তির ট্যাক রেকর্ডেও দেখা যায় যে অতীতে সে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন, বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়েছে।
এতক্ষণ ধরে যে সব ঘটনাবলী বলা হলো সে সবের প্রেক্ষিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের এই ঝটিকা সফর রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজ এবং বাংলাদেশের প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি করে। আরও একটি বিষয় পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। সেটি হলো, যেদিন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা আগমন করেন সেদিনই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আব্দুল মোমেন সিলেট গমন করেন। পরদিন মিঃ শ্রিংলা যখন দিল্লীর উদ্দেশে রওয়ানা হন তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন ঢাকায় ফেরেননি। সুতরাং পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোমেনের সাথে মিঃ শ্রিংলার দেখা হয়নি এবং কোনো বৈঠক হয় নাই। তাহলে কি মিঃ শ্রিংলা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব আব্দুল মোমেনের সাথে বৈঠক করার জন্য ঢাকা এসেছিলেন? তাও আবার করোনা ভাইরাসের এই বিপজ্জনক পরিবেশে? সেটাও আবার একটি বিশেষ বিমানে?
অবশ্যই নয়। তাকে পাঠানো হয়েছিলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে। তিনি এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ দূত হিসাবে এবং মিঃ মোদির একটি বার্তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করতে। কি ছিলো সেই বার্তায়? কি কথা বলেছেন তাঁরা রাত ৮টার বৈঠকে? সে কথা প্রকাশ করা হয়নি এবং এ ধরণের টপ সিক্রেট ডিপ্লোম্যাসি কোনো দিন প্রকাশ করা হয়না। তবে গত ১৯ ও ২০ আগস্ট বাংলাদেশ এবং ভারতের এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকায় এসম্পর্কে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর ওপর চোখ বুলালে হয়তো একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

॥ তিন ॥
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যে কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এসম্পর্কে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় সাংবাদিকদের ব্রিফিং দেন। শুক্রবার ২১ আগস্ট দৈনিক ‘প্রথম আলোর’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম, “শ্রিংলার ঢাকা সফরে তিস্তার প্রসঙ্গ ওঠেনি” খবরে বলা হয়েছে, ব্রিফিংয়ে এই সফর নিয়ে একাধিক প্রশ্ন ওঠে। সফরে কোন কোন বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে সে সম্পর্কে মুখপাত্র বিস্তারিত জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা প্রসঙ্গ তোলা হয়নি। ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এরআরসি) এবং নাগরিকত্ব সংশোধন (সিএ) নিয়েও কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। মুখপাত্র বলেন, কোভিড প্রতিষেধক উদ্ভাবন এবং তা বন্টন পরিকল্পনা শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব। ঠিক হয়েছে দুই পক্ষেই এই বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। মুখপাত্র বলেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মৈত্রী পাইপ লাইন, আখাউরা আগরতলা, চিলহাটি- হলদি বাড়ী ও খুলনা - মংলা রেললাইনের কাজ আগামী বছর শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

এতক্ষণ ধরে যেসব কথা হলো সেগুলো সরকারি পর্যায়ের কথা। কূটনৈতিক পরিভাষা দিয়ে আসল বিষয়কে আড়াল করার কথা। আসল কথা হলো জাতীয় স্বার্থের তাগিদে বাংলাদেশসহ ভারতের অভিন্ন প্রতিবেশি দেশগুলো যাতে চীনের দিকে হেলে না পড়ে সেজন্য ভারতের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঝালাই এবং তাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা হিসাবে হর্ষবর্ধণ শ্রিংলার বাংলাদেশে এই ঝটিকা সফর। এতদিন ধরে নরেন্দ্র মোদি সরবে বলেছিলেন যে ‘প্রতিবেশি আগে’ (Neighborhood first). কিন্তু সেই নীতি কার্যকরী করার ক্ষেত্রে ভারতের আন্তরিকতার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। নেপালের সাথে চীনের নৈকট্য বেড়েছে এবং তার বিপরীতে নেপালের সাথে ভারতের দূরত্ব বেড়েছে। একই অবস্থা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও। চীনের অর্থায়নে শ্রীলঙ্কার একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিপুল অর্থায়ন করেছে এবং এসব প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি চীন ঘোষণা করেছে যে চীনে বাংলাদেশের যেসব পণ্য রপ্তানি হবে তার ওপর থেকে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত হবে।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য চীন একটি মেডিকেল টীম পাঠিয়েছিলো। চীনের করোনা টীকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল বাংলাদেশে করার জন্য চীন প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল গবেষণা পরিষদ সেই ট্রায়ালের অনুমোদনও দিয়েছিল। তারপর এক অজ্ঞাত কারণে সেই ট্রায়াল ঝুলে গেছে। বছরের পর বছর ধরে ভারত তিস্তার পানি বন্টন ঝুলিয়ে রেখেছে। বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পানিতে উত্তরবঙ্গের মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে মরুকরণ হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনার একটি কম্প্রিহেনসিভ প্রজেক্ট তৈরি করেছে। আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮৩.২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এতবড় প্রকল্পে ডোনার পাওয়া যাচ্ছিলো না। অবশেষ একাধিক চীনা ফার্ম অর্থায়নসহ এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনা আগ্রহ প্রকাশের সাথে সাথেই ভারতের টনক নড়েছে। কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের আর ভারতের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। এই প্রকল্পের অন্যতম অংশ হলো বিশাল একটি জলাধার নির্মাণ। বৃষ্টির পানি ঐ জলাধারে ধরে রাখা হবে।

আরেকটি কারণ হলো বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের তৃতীয় ও ফাইনাল ট্রায়াল। এটি হলে ভ্যাকসিনের জন্য ভারতের দুয়ারে ধর্ণা দিতে হবে না। এসবের একটি হিল্লে করার জন্য হর্ষবর্ধণ শ্রিংলাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিলো।
asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/424954