২৫ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৩:২৭

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পর্যটন শিল্প-৩

ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের এখন বেঁচে থাকা দায়

করোনা মহামারীর ধাক্কা লেগেছে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর ব্যবসায়। বর্তমান অবস্থায় দেনা আর লোকসানের বোঝা নিয়ে ব্যবসায়ীদের এখন বেঁচে থাকা দায়। যাত্রী না থাকায় এ খাতের ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনও দিতে পারছে না তারা। প্রতিদিন লোকসান গুনতে হচ্ছে শত কোটি টাকা। এরই মধ্যে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কারো ব্যবসা চালু থাকলেও কোনো আয় না থাকায় দিনে দিনে দেনার বোঝা বাড়ছে। মাসের পর মাস ধরে আটকে আছে অফিস ভাড়া, বিদ্যুৎ ও পানির বিল, কর্মচারী বেতনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়। এরই মধ্যে অনেকে আগের বুকিং টিকিট বাতিল করছে। অনেকেই টিকিটের রিফান্ড চাচ্ছে। তার সাথে আটকে আছে ব্যবসায়ীদের পূর্বের পাওনা। সব মিলিয়ে ট্রাভেল এজেন্সি এখন গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে এই ব্যবসায় টিকে থাকা যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন এর সাথে সংশ্লিষ্টরা।

ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বর্তমানে সীমিত আকারে ফ্লাইট চালু হলেও চ্যাটার্ড ফ্লাইটের মাধ্যমে তাদের আরো ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তাদের অভিযোগ বিশেষ ফ্লাইটগুলোর টিকিট কোনোভাবে তাদের মাধ্যমে বিক্রি করা হলে সরকার এবং ব্যবসায়ী দুই পক্ষই লাভবান হতো। তা না করে কয়েক গুণ দাম বাড়িয়ে যে প্রক্রিয়ায় এগুলো বিক্রি হচ্ছে তাতে একটি সিন্ডিকেট ছাড়া অন্য কেউ লাভবান হচ্ছে না।

ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস কোম্পানিগুলো সাধারণত ট্যুরিস্ট ভিসা, বিজনেস ভিসা, মেডিক্যাল ভিসা, হজ ও ওমরাহ ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা প্রসেস এবং ট্যুর প্যাকেজ, ট্যুর কন্সালট্যান্সি ও এয়ার টিকিটিংয়ের কাজ করে থাকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে তারা পরিস্থিতির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না। এ অবস্থায় তাদের হাজার হাজার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির সাথে লাখ লাখ হাজার কর্মীর জীবন ও জীবিকা ইতোমধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে। তারা বলছেন, করোনার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন বাড়ছিল বাংলাদেশে আসা ভ্রমণকারীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছিল এ খাতের উদ্যোক্তার সংখ্যা এবং বিনিয়োগও। গত দুই দশকে এই খাতে নতুন করে অন্তত দুই হাজার উদ্যোক্তা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। ফলে ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস খাতে তৈরি হয়েছিল নতুন কর্মসংস্থান। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সম্ভাবনার এ খাত এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এর দেয়া তথ্যানুযায়ী তাদের সদস্য সংখ্যা এক হাজার ২৩৮। ওমরাহ বন্ধ থাকা ও হজ অনুষ্ঠিত না হওয়া ওমরাহ ও হজ এজেন্সিগুলো সর্বসাকল্যে ৬ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার কর্মচারীর বেকার হওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মোট হজযাত্রীর ৯৬ শতাংশ এবং ওমরাহ যাত্রীর শতভাগ কার্যক্রম হাব সদস্য হজ ও ওমরা এজেন্সির মাধ্যমে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন এবং অফিস ভাড়া ও অন্যান্য খরচসহ মাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া এ পেশার সঙ্গে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবে আরো প্রায় এক লাখ লোক নিয়োজিত। ফলে চলমান পরিস্থিতিতে এ খাত বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

এ ছাড়া গত ৯ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া চিঠিতে হাব সভাপতি তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে বলেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সৌদি সরকার ওমরাহ বন্ধ ঘোষণার পর ১০ হাজার ওমরাহ যাত্রীর ভিসা, এয়ার টিকিটের মূল্য বাবদ ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। এ ছাড়াও আসন্ন রমজান মাসে ওমরাহ হজে গমনকারীদের জন্য আরো ২৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫ বাজার এয়ার টিকিট অগ্রিম কেনা হয়। এ ছাড়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মার্চ মাসের বেতন ও অন্যান্য অফিস খরচসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে করে এ বাবদ লোকসানের পরিমাণ ১৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া এর সাথে জড়িত ১০ হাজার কর্মচারী এবং বাংলাদেশ ও সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশসহ পরোক্ষভাবে জড়িত ৫০ হাজার ব্যক্তির চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া চিঠিতে চার দফা প্রণোদনা প্রস্তাবের শেষে হাব সদস্য, হজ, ওমরাহ ও ট্রাভেল এজেন্সির অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়।

চলমান পরিস্থিতিতে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশের (আটাব) সাবেক সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম সেক্টরে মধ্যে এয়ারলাইন্স, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউজ, রেস্টুরেন্ট, ট্যুরিস্ট বাস, ট্যুরিস্ট জাহাজ অন্তর্ভুক্ত। আমরা একটা সমীক্ষা করে দেখেছি, আমাদের এখানে প্রত্যক্ষভাবেই পেশাজীবী মানুষ আছে প্রায় ৪০ লাখ। প্রতিদিন আমাদের ১০০ কেটি টাকার ওপর লোকসান যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা একটা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। সমস্ত এজেন্সির এখন দিশেহারা অবস্থা। এর মধ্যে কিছু এজেন্সি আছে খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। তাদের অনেকে পরিবার নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। আমাদের অনেক সদস্য কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না। অফিস ভাড়া দিতে পারছে না।

আটাবের সাবেক এই সভাপতি বলেন, দেশ স্বাভাবিক হওয়ার পর অফিস, আদালত খোলার পরও আমাদের ব্যবসা চালু হবে না। কমপক্ষে ছয় মাস লাগবে ফ্লাইট চালু হতে। আবার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী যেতে পারবে তাও কিন্তু না। মিশনগুলো চালু হতে হবে, অ্যাম্বাসিগুলো চালু হতে হবে। অ্যাম্বাসি ভিসা না দিলে তো মানুষ পাঠানো যাবে না। করোনাভাইরাসের কারণে ট্রাভেল ও ট্যুরিজম খাতে যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে সরকার সরাসরি সহযোগিতা না করলে এই সেক্টর টিকতে পারবে না। এ জন্য এ খাত সংশ্লিষ্টদের সুদমুক্ত ঋণসুবিধা ও করছাড় দিতে হবে। সেই সঙ্গে এ খাতের স্বল্প বেতনের কর্মীদের ১০ টাকার রেশন কার্ড দিতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/517541/