২৫ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৩:২৫

অনিয়মের বেড়াজালে মেডিক্যাল নির্মাণ প্রকল্প

সমীক্ষা ছাড়াই ৬১১ কোটি টাকার প্রকল্প; একনেকের নির্দেশে ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; তিন বছরের প্রকল্প আট বছরে ৩৪ শতাংশ অগ্রগতি

যত অনিয়ম ও নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা সবই স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পে। আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না তারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেক সভায় দেয়া নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করে অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আজো ব্যবস্থা নেয়নি। কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পটি নানা অনিয়মের বেড়াজালে তিন বছরের প্রকল্প আট বছরে মাত্র ৩৪ শতাংশ কাজ হয়েছে। সরেজমিন বেরিয়ে এসেছে, একটি ভবনের কাজ একাধিক প্যাকেজ করে কয়েক জন ঠিকাদারকে দেয়া, কাঠামোগত কাজ শেষের আগেই ফিনিশিং দেয়ায় প্লাস্টার, চৌকাঠ, জানালার থাই, গ্রিল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঠিকাদারদের অবহেলার কারণে প্রকল্পের কাজে বিলম্ব এবং একজন নির্মাণ শ্রমিকের প্রাণহানি ও ১০ জন আহত হয়।

প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসক অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে সরকার পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে কুষ্টিয়াতেও একটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের অনুমোদন দেয়। তিন বছরে এই কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য ২৭৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা ছিল। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এভাবে সাত বছর অতিক্রম করে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পরে ২০১৮ সালের ২১ জুন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয় এক লাফে ৬১১ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়নকাল বর্ধিত করা হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৫ জুন প্রকল্পের আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় করা হয়।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য : প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, চিকিৎসা শিক্ষার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা, চিকিৎসক তৈরির মাধ্যমে চিকিৎসক এবং জনসাধারণের আনুপাতিক হার যৌক্তিক করা, চিকিৎসা শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা, প্রান্তিক জেলার তৃণমূল জনসাধারণ পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিদা নিশ্চিত করা।

প্রকল্পের কাজগুলো : ১০ তলা ভিতের ওপর সাততলা হাসপাতাল ভবন, ছয়তলা ভিতের ওপর ছয়তলা একাডেমিক ভবন, ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট চারতলা ছাত্রছাত্রীদের পৃথক হোস্টেল ভবন, ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট ছয়তলা সিঙ্গেল পুরুষ ও মহিলা ডক্টরস পৃথক ডরমেটরি ভবন, ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট চারতলা স্টাফ নার্সদের ডরমেটরি ভবন, ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট চারতলা হাসপাতালের জরুরি স্টাফ নার্সেস ডরমেটরি ভবন, ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট তিনতলা ইন্টার্নি পুরুষ ও মহিলা ডক্টরস পৃথক ডরমেটরি ভবন, ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট দুইতলা আবাসিক ভবন, ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট তিনতলা আবাসিক ভবন, চারতলা ভিত বিশিষ্ট দুইতলা মর্গের ভবন নির্মাণ করা। এ ছাড়া ছয়তলা ভিত বিশিষ্ট চারতলা মাল্টিপারপাস ভবন, চারতলা ভিত বিশিষ্ট দুইতলা দু’টি সাবস্টেশন ভবন, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, আসবাবপত্র সংগ্রহ ও টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ইত্যাদি।

কাজের অগ্রগতি : আইএমইডির সরেজমিন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের সংশোধিত ৬১১ কোটি টাকা খরচের বিপরীতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আট বছরে খরচ হয়েছে ২০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৩৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মূল ডিপিপি অনুযায়ী তিন বছরে বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত খাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ৬৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্মাণ খাত, ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ যন্ত্রপাতি ক্রয়, সাত দশমিক ৯৭ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণ এবং আসবাবপত্র ক্রয় হলো চার দশমিক ২৯ শতাংশ। এর মধ্যে নির্মাণ খাতে আর্থিক অগ্রগতি হলো ৩২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আট বছরে ভৌত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩৪ শতাংশ। ইতোমধ্যে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে ২০০ শতাংশ। যেখানে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা।

ব্যত্যয়গুলো হলো : মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সংশোধন অনুযায়ী শেষ হয়েছে। কিন্তু আরো ছয় মাস অতিক্রম করার পর আজো দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ বাড়নো হয়নি। এমনকি ২০১৭-২০১৮ সালে প্রকল্প মেয়াদ না থাকায় কার্যক্রম স্থবির ছিল। লক্ষ্যমাত্রার আলোকে প্রধান প্রধান ভবনের কোনোটিরই কাজ শতভাগ বাস্তব অগ্রগতি সম্পন্ন হয়নি। বাস্তবায়িত সব ভবনের জন্য দরপত্র আহ্বান সম্ভব হয়নি।

একটি ভবনের নির্মাণকাজকে একাধিক প্যাকেজে বিভক্ত করার কারণে প্রতিটি প্যাকেজের জন্য আলাদা দরপত্র আহ্বান ও আলাদা কমিটি করা হয়েছে। ফলে দরপত্র মূল্যায়ণে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ অপচয় হয়েছে। পুরো প্রকল্পের নির্মাণকাজে ৭১টি প্যাকেজে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি ভবন নির্মাণে সর্বোচ্চ চারটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়ছে। একটি প্যাকেজকে অনেকগুলো ছোট ছোট প্যাকেজে বিভক্তিকরণ করায় ঠিকাদার স্বল্প টেন্ডার সিকিউরিটি এবং সীমিত পারফরম্যান্স গ্যারান্টি প্রদানের মাধ্যমে কাজগুলো করার সুযোগ পেয়েছে। সীমিত আকারের কাজে অনেক ক্ষেত্রে স্বানমধন্য ঠিকাদাররা কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। এ ছাড়া একটি ভবন নির্মাণের জন্য একাদিক প্যাকেজের মাধ্যমে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে। ফলে একাধিক ঠিকাদার একটি ভবনের কাজ পরিচালনার জন্য সম্পৃক্ত হয়েছে। এখানে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

২০১৮ সালের ২১ জুনের একনেক সভায় প্রকল্পের প্রথম সংশোধন অনুমোদনের প্রাক্কালে সিদ্ধান্ত হয়, যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে অনুমোদিত ডিপিপির সংস্থানকৃত নির্মাণকাজে যেসব অনিয়ম করা হয়েছে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সেই নির্দেশ মোতাবেক আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।

বিধি অনুযায়ী ২৫ কোটি টাকার বেশি কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প করতে হলে আগে তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। কিন্তু এই প্রকল্পে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। সেটা না করার কারণে প্রকল্পের ভবনগুলোর প্রাক্কলনের আগে সুনির্দিষ্ট ফরমেশন গ্রাউন্ড লেবেল নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। নির্মাণাধীন ভবনের কাঠামোগত কাজ সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই ফিনিশিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। ফলে প্লাস্টার, চৌকাঠ, জানালার থাই, গ্রিল, টাইলস ইত্যাদি নষ্ট হচ্ছে।

অন্য দিকে, দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ডিপিপিতে অনুমোদিত ২০০৮ সালের রেট শিডিউলের পরিবর্তে ২০১১ সালের দর অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়। গণপূর্ত অধিদফতর গত ২০১৮ সালের ১ মে নির্মাণসংক্রান্ত নতুন দর কার্যকর করে। কিন্তু রেট শিডিউল কার্যকর করার পরেও ২০১৮ সালের ২১ জুন পূর্ববর্তী ২০১৪ সালের রেটে প্রকল্প সংশোধন করে একনেকে অনুমোদন নেয়া হয়, যা পরে সমস্যার সৃষ্টি করে। মাঠপর্যায়ে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে অধিকাংশ ঠিকাদার কোনো ওয়ার্ক প্রোগ্রাম প্রদান করেননি। প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামো বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ গণপূর্ত অধিদফতরের সাথে স্থাপত্য অধিদফতরের সমন্বয়হীনতার কারণে নির্মাণকাজে অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে। আর্কিটেকচারাল নকশা ও স্ট্রাকচারাল নকশা যথাযথ সময়ে মাঠপর্যায়ে সরবরাহ না করার কারণে নির্মাণকাজে বিলম্ব হয়।

অন্য দিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরুর আগেই ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রতি ব্যাচে ৫০ জন করে শিক্ষার্থী এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বতর্মানে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলমান আছে, সেখানে নির্মাণকাজই শেষ হয়নি।

আইএমইডির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সমন্বয়হীনতার কারণে নির্মাণকাজে স্ববিরতা। এখানে পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণকাজ সম্ভব না হওয়াতে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি কেনা সম্ভব হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছর কাজ বন্ধ ছিল। প্রকল্পে কাজের গতি মন্থর। অধিকাংশ কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। ৩০ একর জমি অধিগ্রহণের মধ্য আট বছরে অধিগ্রহণ হয়েছে ২০ একর। ভবনগুলোর নির্মাণকাজ এখনো অসমাপ্ত। ১৮টি ভবনের মধ্যে এখনো ৫টির দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। ঠিকাদারের অবহেলার কারণে নির্মাণকাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে না। ঠিকাদারের অবহেলার কারণে শ্রমিকের মৃত্যু ও ১০ জন আহত হন। আট বছরে তিনবার প্রকল্প পরিচালক বদলি করা হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/517544/