১৯ জুলাই ২০২০, রবিবার, ১২:২২

বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা

এএফসি ফর্টিসের প্রতারণা

অনুমোদন ছাড়াই কোভিড রোগীদের এন্টিবডি পরীক্ষা প্রতারণার শামিল -সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার * ঢাকায় ৫ প্রতিষ্ঠানের আরটিপিসিআর অনুমোদন স্থগিত

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ‘প্রতারণা’র অভিযোগ উঠেছে চেইন হাসপাতাল এএফসি ফর্টিস হার্ট ইন্সটিটিউটের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ কোভিডের নামে অনুমোদনহীন এন্টিবডি পরীক্ষা করা। এছাড়া ২০১৮ সালের পর হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। খুলনা ও কুমিল্লায় অনুমোদন ছাড়াই করোনার এন্টিবডি পরীক্ষা করছে।

হাসপাতালটির কুমিল্লা শাখায় মাত্র ১৯ জন রোগীর চিকিৎসা বাবদ বিল করা হয়েছে ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৩৬ টাকা। আর হাসপাতালের আইসিইউ ও অন্যান্য পরিকাঠামো ব্যবহার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ রোগীপ্রতি খরচ ২৯ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে এই বিল স্বাস্থ্য অধিদফতর ও কুমিল্লা সিভিল সার্জনকে পাঠানো হয়েছে।

করোনা চিকিৎসা সেবার নামে প্রতারণায় রিজেন্ট ও জেকেজির পর সামনে এলো এএফসি ফর্টিস হার্ট ইন্সটিটিউটের নাম। এদিকে রাজধানীর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আরটিপিসিআর (যারা কোভিড-১৯ রোগীর নমুনা পরীক্ষা করার অনুমোদন পেয়েছিল) অনুমোদন স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য (কুমিল্লা-৬) হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি এই হাসপাতালটি সরকারি অনুমোদন ছাড়াই কোভিড রোগীদের এন্টিবডি পরীক্ষা করেছে। এটা প্রতারণার শামিল। এছাড়া তারা যে বিল করেছে, সেটিও করা ঠিক হয়নি।

জানা যায়, দেশে এএফসি ফর্টিস হার্ট ইন্সটিটিউটের তিনটি শাখা রয়েছে। এগুলোর একটি খুলনায়, একটি চট্টগ্রামে এবং অপরটি কুমিল্লায়। কোভিড চিকিৎসা ও আইসিইউ বিলের দাবি করা হয়েছে কুমিল্লা থেকে। ইন্ডিয়া থেকে নার্স আনা হয়েছে ট্যুরিস্ট ভিসায়। এছাড়া হাসপাতালের নার্র্স-চিকিৎসকদের দীর্ঘমেয়াদি বেতন বকেয়া রাখা হয়েছে। বেতনের দাবি করায় অনেককে কোনো টাকা পরিশোধ ছাড়াই দেয়া হয়েছে অব্যাহতি। এছাড়া রোগীদের নানা অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।

অনুমোদন না থাকলেও অ্যান্টিবডি টেস্ট করানোর বিষয়ে এএফসি ফর্টিস কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই পরীক্ষা রোগীদের সিক্রিনিং হিসেবে দেখানো হবে। যা বিল নির্ধারণ করা হয়েছে সাধারণ রোগীদের জন্য আড়াই হাজার টাকা এবং হাসপাতালের কর্মীদের জন্য ১ হাজার ৭৫০ টাকা।

কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াতুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, জেলা করোনা প্রতিরোধবিষয়ক মাল্টি সেক্টর কমিটি করোনা রোগীদের চিকিৎসায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্ধারণ করে। কিন্তু সেখনে কোনো আইসিইউ নেই। আইসিইউ স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত বেসরকারি এএফসি হেলথ ফর্টিস হার্ট ইন্সটিটিউটের সিসিইউ ইউনিট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

যাতে মুমূর্ষু করোনা রোগীদের ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেয়া যায়। সে অনুসারে ১০ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত ১৯ জন করোনা রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। বাকি ১৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এসব রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকারি ডাক্তার ও নার্সদের সংযুক্তি দেয়া হয়। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আয়া নিয়োগ দেন।

ডাক্তার ও নার্সদের থাকার ব্যবস্থা হয় কুমিল্লা ক্লাবে এবং খাওয়ার ব্যবস্থা হয় জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে। এমনকি রোগীদের সব ওষুধও সরকারি হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ, শুধু হাসপাতালটির কয়েকটি শয্যা, আইসিইউ ও প্রয়োজেন ভেন্টিলেশন ব্যবহার করা হয়েছে। সিভিল সার্জন বলেন, এতকিছুর পরও ফর্টিস কর্তৃপক্ষ রোগীদের সেবা বাবদ ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৩৬ টাকা ও আইসিইউসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা বাবদ ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকার বিল দাখিল করে।

এএফসি ফর্টিস হার্ট ইন্সটিটিউট খুলনার বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। এই শাখায় কোভিড-১৯ রোগীদের পরীক্ষার নামে অনুমোদনহীন এন্টিবডি পরীক্ষা করা হচ্ছে। কোভিড আক্রান্ত নার্সদের দিয়ে জোরপূর্বক হাসপাতালের কাজ করানো হচ্ছে। হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার-নার্সদের কোভিড-১৯ উপসর্গ থাকলেও তাদের কোনো পরীক্ষা করতে দেয়া হয়নি।

এমনকি বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধান কোভিড সন্দেহে কর্মীদের ছুটি দিলেও কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করে দেয়। অনেক কর্মীকে না জানিয়েই কোভিড রোগীদের সেবা করতে বাধ্য করা হয়। দেয়া হয় না ন্যূনতম সুরক্ষা সরঞ্জাম। প্রতিবাদ করায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন নার্স ও ডাক্তারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এসব অভিযোগ হাসপাতালটিতে কর্মরতদের।

২৮ জুন হাসপাতালটির খুলনা শাখার নার্সিং বিভাগের প্রধান সুলেখা ফিরোজ কর্তৃপক্ষকে এক চিঠি দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আপনার নির্দেশ অনুসারে আমি অসুস্থজনিত ছুটিতে থাকা কর্মীসহ ২২ নার্সকে দিয়ে ডিউটি করিয়েছি। তাদের কয়েকজনের মধ্যে কোভিড-১৯’র হালকা ও মাঝারি লক্ষণ রয়েছে।

আমি অসুস্থদের ছুটিতে থাকার নির্দেশ দিয়েছি, তবে তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এজন্য একজন নার্সকে হাসপাতালে আসতে হয়েছে। তিনি জ্বরে ভুগছেন, কোভিড ১৯ টেস্টের অনুমতি না থাকায় সেটি করা হয়নি।

অপর এক চিঠিতে তিনি লেখেন, আমার ইমেইলে গত মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের অনুরোধের কোনো সাড়া দেয়া হয়নি। আমি ইমেইলে উল্লেখ করেছি আমার পিতা গুরুতরভাবে অসুস্থ। আমি কেবল আমার বকেয়া বেতনের জন্য অনুরোধ করছি, অগ্রিম চাইনি।

ইউসুফ আলী নামে একজন রোগীর স্বজন লিখিত অভিযোগ করেন, জরুরি প্রয়োজনেও কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায় না। একটি ডায়ালাইসিস মেশিন নষ্ট থাকায় সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।

কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট সরদার জাহিদ হোসেন লিখিত অভিযোগে বলেন, আমি ১ জুলাই ২০১৮-তে যোগদান করি। তারপর থেকে আমি বাড়ি ভাড়া ও আসবাবের ভাতা পাইনি। বারবার অনুরোধ করার পরও আমাকে কোনো ভাতা দেয়া হচ্ছে না। এ পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ ২৪ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৮ টাকা। এরকম আরও অনেক অভিযোগ যুগান্তরের হাতে রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এএফসি ফর্টিস হার্ট ইন্সটিটিউটের জিএম অপারেশন তৌফিক হাসান যুগান্তরকে বলেন, রোগীদের চিকিৎসা বাবদ ৫ কোটি ৪১ লাখ বিল করা হয়নি। আমার প্রতিষ্ঠানের আইসিইউ ছিল না; কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন আইসিইউ প্রস্তুত করতে বললে আমরা সেটি করি।

যে ব্যয় ধারা হয়েছে, এটি স্টাবলিশমেন্ট কস্ট। তখন তারা বলেছে, আমাদের খরচ দেয়া হবে; কিন্তু এখন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। লাইসেন্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের লাইসেন্স নবায়ন ফরম অনলাইনে জমা দেয়া আছে। কর্মীদের বেতন না দেয়া ও ছাঁটাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনাকালীন সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। বেতনের সমস্যা থাকবে না।

ঢাকায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আরটি পিসিআর (যারা কোভিড-১৯ রোগীর নমুনা পরীক্ষা করার অনুমোদন পেয়েছিল) অনুমোদন স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হল- কেয়ার মেডিকেল কলেজ, এপিক হেলথ কেয়ার, থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড, স্টিমজ হেলথ কেয়ার (বিডি) লি. এবং শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ।

গত রোববার অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা পৃথক চিঠিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্থগিত করেন। এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধানের উদ্দেশে তিনি বলেন, অধিদফতর আপনার প্রতিষ্ঠানকে কোভিড-১৯ আরটিপিসিআর পরীক্ষার অনুমোদন প্রদান করা হলেও অদ্যাবধি কার্যক্রম শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এ কারণে আরটিপিসিআর পরীক্ষার অনুমোদন সাময়িক স্থগিত করা হল। ল্যাবরেটরি সম্পূর্ণভাবে আরটি পিসিআর পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া সাপেক্ষে পুনরায় আবেদন করতে হবে। কিটের অনাপত্তি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে নিতে হবে। পরবর্তী সময়ে সরেজমিন পরিদর্শন রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/327167/