১৯ জুলাই ২০২০, রবিবার, ১২:২১

শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ

দরপত্র জমার পরদিন কার্যাদেশ

হংকংয়ে পাচার ৩০ কোটি টাকা, আরও ১০২ কোটি টাকা প্রক্রিয়াধীন * ৫ টাকার যন্ত্রপাতি ১৫ টাকায় কেনার পরও প্যাকেটবন্দি

সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বেঙ্গল সায়েন্টেফিক নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২৪২ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিতে তারা একটি প্রভাবশালী সমিতির নাম ব্যবহার করেছে। উন্মুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ না করে একদিনে দরপত্র দাখিল এবং পরের দিন বিশেষ কায়দায় কার্যাদেশ দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।

দুদকের কালো তালিকাভুক্ত বেঙ্গল সায়েন্টেফিকের স্বত্বাধিকারী জাহের উদ্দিন নানা কায়দাকানুন করে প্রকল্পের ৩০ কোটি টাকা হংকংয়ে পাচার করে। আরও ১০২ কোটি টাকা পাচারের প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিষ্ঠানটি যে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে, তা-ও বাক্সবন্দি অবস্থায় আছে। ৫ টাকার জিনিসের দাম ধরা হয়েছে ১৫ টাকা। তারা যথাযথ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে কি না, তা না দেখেই বিলও পরিশোধ করে দেয়া হয়। দুদকের অনুসন্ধানে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে।

জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ওই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার বরাদ্দ দেয় সরকার। খবর পেয়ে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তুতি শুরু করে জাহের উদ্দিনের প্রতিষ্ঠান। জাহেরের মালিকানাধীন হংকংয়ের ফার্ভেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে এ খাতের টাকা স্থানান্তরের রাস্তাও তিনি খোলেন।

সে অনুযায়ী ৩০ কোটি ৩ লাখ টাকা ডলার এবং ইউরো আকারে হংকংয়ের সিটি ব্যাংকের ২৫০৩৯০৮৬৭৪৯১৫৩ নম্বর হিসাব অনুকূলে পাঠানো হয়। হিসাবটি ওই দেশে বেনিফিশিয়ারি ফার্ভেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের নামে আগেই খোলা হয়েছে। মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনায় অন্তত ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমে প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, অনুসন্ধানে যাদের নাম ও সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসবে, তাদের আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব। বিধি ভঙ্গ করে যারা রাষ্ট্রের টাকা আত্মসাৎ করে, তাদের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

‘শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন’ প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে শুরু করা হয়। ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৯ সাল মেয়াদি প্রকল্পের জন্য ৬৩৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি একনেক সভায় ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) অনুমোদিত হয়।

দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, জাহের উদ্দিন একটি সমিতির নাম ব্যবহার করে কাজটি নেন। জহির উদ্দিনই মূলত কাজ পেতে ওই সমিতিকে তার সঙ্গে সংযুক্ত করেন বলে দুদক জানায়। এরপর শুরু হয় প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা। ২৪২ কোটি টাকার মধ্যে ১৩২ কোটি টাকার কার্যাদেশ দিয়ে বিলও দেয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।

টাকা বৈধ দেখানোর জন্য নিয়মরক্ষার একটি সূত্র আবিষ্কার করেন জাহের উদ্দিন। যেহেতু তার হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফার্ভেন্ট কোম্পানি লিমিটেড যন্ত্রপাতি সাপ্লাই দেয়ার কথা, তাই কার্যাদেশের টাকা ‘ইন টার্মস অব ডলার’ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জমা করে। বাংলাদেশি মুদ্রা ডলার ও ইউরো করে হংকং পাঠানোর জন্য প্রথম ধাপের ১৩২ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ফান্ডে ট্রান্সফার করে।

কার্যাদেশ তথা এলসি ডকুমেন্টস অনুযায়ী ১৩২ কোটি টাকার মধ্যে ৩০ কোটি টাকা এরই মধ্যে হংকংয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। আরও ১০২ কোটি টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। জাহাজীকরণ ডকুমেন্ট (শিফমেন্ট) জমা দিয়েই এই টাকা স্থানান্তর করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের উদ্দেশ্যেই ওই অর্থ বিশেষ প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। জাহের উদ্দিন টাকা তুলে নিলেও সামান্য কিছু মালামাল এসেছে। তা-ও হাসপাতালে প্যাকেটবন্দি অবস্থায় আছে। এই যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) জন্য এলইডি লাইট, এক্সরে মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। দেশে এই লাইট সবচেয়ে ভালোটার দাম সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। যার আমদানি মূল্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। কিন্তু জাহের উদ্দিনের প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পায় প্রতিটি ২৮ লাখ টাকায়।

অভিযোগের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ডা. কৃষ্ণ কুমার পাল শনিবার মুঠোফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমরা ৪০ কোটি টাকার মালামাল পেয়েছি কার্টনে করে। তবে সেগুলো এখনও খোলা হয়নি। কার্টনের ভেতরে কী কী মালামাল আছে, তা কার্টনের গায়ে চালানের সঙ্গে লেখা আছে। আমরা কার্টন রেখে দিয়েছি। একদিনে কার্যদেশ দাখিল, পরের দিন কার্যাদেশ প্রদানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি চুপ হয়ে যান। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এই কার্যাদেশ থেকে কোনো কমিশন ভাগ নিইনি। যা করেছি, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই করেছি।

দুদক সূত্র জানায়, দেশের বাইরে সিস্টেমের মধ্যে টাকা স্থানান্তরের জন্য জাহের উদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংককেও ব্যবহার করে। এর আরেকটা কারণ হল সরকারের ৪৬ ভাগ রাজস্ব, ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ ট্যাক্স, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ এআইইটি’র পাওনা রয়েছে।

জানা যায়, কয়েক ধাপে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের অর্থ আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়টি যেমন আছে, তেমনই কম দামের জিনিস এনে বেশি দামে সরবরাহ করার বিষয়ও আছে। দরপত্রে উল্লেখ থাকা যন্ত্রপাতির অতিমূল্যায়ন দেখিয়ে বিল বেশি করা হয়।

মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কীভাবে যন্ত্রপাতি বুঝে না নিয়ে বিল পরিশোধ করল, এ বিষয়ে জানতে কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. নজরুল ইসলাম বকুলকে একাধিকবার ফোন করা হয় যুগান্তরের পক্ষ থেকে। তিনি ফোন ধরেননি। তাকে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। পরে আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, প্রিন্সিপাল হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন।

দুদকের অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনায় ডিপিএম পদ্ধতি অনুমোদনের আগেই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদনের শর্ত লংঘন করে কার্যাদেশ দেয়া হয়। তারা ক্রয়প্রক্রিয়ায় উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ করেনি। ২০০৬ সালের পিপিএ এবং ২০০৮ সালের পিপিআর অনুযায়ী ক্রয়কৃত মেডিকেল যন্ত্রপাতির মূল্য নির্ধারণ বা মূল্য যাচাই করা হয়নি।

মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরাসরি পদ্ধতিতে ক্রয় বা সংগ্রহের জন্য প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর কোটেশন আহ্বান করা হয়। ওই বছর ৪ নভেম্বর কোটেশন দাখিল করা হয়। দাখিলকৃত কোটেশন মূল্যেই প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে একদিন পর ৫ নভেম্বর নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড ইস্যু করা হয়। সেই মোতাবেক চুক্তিও সম্পাদন করা হয়। কর্তৃপক্ষ ১৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ২৭টি পৃথক ব্যয় মঞ্জুরিপত্র প্রদান করে। পরে তা প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সিজিএ কার্যালয়কে অবহিত করে।

প্রতিষ্ঠানটি ৭০টি মেডিকেল আইটেম কাস্টমস থেকে ছাড় করিয়ে কার্টনবন্দি অবস্থায় সরবরাহ করলেও ‘শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন’ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কার্যাদেশের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কোনো মেডিকেল যন্ত্রপাতি বুঝে পায়নি। কিন্তু বিল শোধ করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে জাহের উদ্দিনের ফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা অর্থ পাচারের অভিযোগটি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি জানান, কোম্পানির কয়েকজন মিলে সিএন্ডএফ বরাবর টাকা পাঠান।

এদিকে দুদক সূত্রে জানা গেছে, জাহের উদ্দিনের বেঙ্গল সায়েন্টেফিক স্বাস্থ্য খাতের কালো তালিকাভুক্ত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি এর আগে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৫ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরবরাহে ৪ কোটি টাকা, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও সদর হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে ২৫ কোটি টাকা গায়েব করে দিয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/327169/