১১ জুলাই ২০২০, শনিবার, ২:০৭

করোনাভাইরাসের ধাক্কা: চামড়া শিল্পে কোনো সুখবর নেই

অবিক্রীত ৩২শ’ কোটি টাকার চামড়ার স্তূপ * ৩ শতাংশ সুদে ৬শ’ কোটি টাকার ‘ক্যাশ ক্রেডিট’ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ের * আগের ঋণ ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর, ৩ বছরের সুদ মওকুফসহ অন্যান্য সুবিধা চান মালিকরা

বৃহস্পতিবার রাত ১০টা। গুগল জুমে বিদেশি এক বায়ারের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকার ট্যানারি শিল্পোদ্যোক্তা ফায়জুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। সাভারে তার ফ্যাক্টরিতে পণ্যের মজুদ, করোনার ধাক্কা, ব্যাংক ঋণসহ সব দুর্বলতাই তুলে ধরেছেন ওই ক্রেতার কাছে। সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেও আশার আলো দেখতে পাননি তিনি।

কারণ করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশি ক্রেতা চামড়া নিতে রাজি নন। সাফ বলে দিয়েছেন, নিজের দেশে (ইতালি) ফ্যাশনেবল আইটেমের চাহিদা কমে গেছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কেনাকাটা করছেন না। ইতালিতে গড়ে উঠা তার ফ্যাক্টরিও প্রায় বন্ধ। ফলে বাংলাদেশ থেকে এখনই চামড়া কেনার আগ্রহ নেই।

করোনার প্রভাবে চামড়ার প্রধান বাজার চীন, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, হংকংসহ অধিকাংশ দেশে রফতানি বন্ধ। ফলে ৩ হাজার থেকে ৩২শ’ কোটি টাকার চামড়া বিভিন্ন ট্যানারিতে পড়ে আছে। এর মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা মূল্যের ওয়েট ব্লু এবং ৬-৭শ’ কোটি টাকা মূল্যের ক্রাস্ট।

এ পরিস্থিতিতে আসছে কোরবানির ঈদ। যেখান থেকে সারা বছরের ট্যানারি শিল্পের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে চামড়া সংগ্রহ হবে তা নিয়ে চিন্তিত সব পক্ষই।

চামড়ার শিল্পের বর্তমান অবস্থা আঁচ করতে পেরে ৮ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে কোরবানির চামড়া কিনতে ট্যানারি মালিকদের সহজ শর্তে ৩ শতাংশ সুদে ৫-৬শ’ কোটি টাকা ক্যাশ ক্রেডিট দেয়ার পদক্ষেপ নিতে বলা হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্যানারি শিল্প কোনো ব্যবসা করতে পারেনি। এ সময় ৩২শ’ কোটি টাকার চামড়া অবিক্রীত পড়ে আছে। অপরদিকে ট্যানারির অনুকূলে ব্যাংক ঋণের সুদ হয়েছে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ কোটি টাকা।

চামড়া ব্যবসায় ফিরতে হলে এ সুদ মওকুফ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঋণগুলো ১৬ বছরের জন্য ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে। এসব বিবেচনায় না নিয়েই সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চামড়া ব্যবসায়ীদের ঋণ সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে প্রকৃত ট্যানারি মালিকদের কোনো উপকার হবে না।

রুমা লেদার ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. আবু তাহের যুগান্তরকে বলেন, করোনা মুক্ত না হলে এ দেশে কোনো বায়ার আসবে না। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে, এর সুদ দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ অবস্থায় কোরবানির চামড়া কিনতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার দিয়েছে এর সুফল পাওয়া যাবে না। এজন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও দূর করতে হবে।

জানা গেছে, চীনের রফতানির বড় বাজার আমেরিকা। সেখানে পণ্য বিক্রি কমেছে। আবার বাংলাদেশের চামড়ার বড় বাজার চীন। একই কারণে চীনে চামড়া রফতানিও কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে কোরবানির ঈদ আসন্ন। তবে ট্যানারির মালিকরা এ নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

এছাড়া এ শিল্পের অনুকূলে ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ রয়েছে। আর এ ঋণের বিপরীতে সুদ দাঁড়িয়েছে ৭শ’ কোটি টাকা। ফলে ব্যবসা না থাকলেও ঋণের সুদে নুয়ে পড়ছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

কোরবানির চামড়া নিয়ে গভর্নরকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা : ৮ জুলাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়, ২৯ জুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সব পক্ষকে নিয়ে সভা করে। এতে চামড়া শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ এবং আসন্ন কোরবানি ঈদে চামড়া কেনার জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।

এছাড়া রফতানিমুখী শিল্পের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় চামড়া শিল্পের জন্য আর্থিক সহায়তা ও চামড়া ব্যবসায় জড়িতদের ঋণ দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সার্বিক বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে কার্যক্রম চলমান।

এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। সেই চিঠির আলোকে চামড়া শিল্পের ব্যাংক ঋণ ২০১৭-১৯ এ ৩ বছর পর্যন্ত সুদ মওকুফ, পূর্বের ব্যাংক ঋণ ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর ও আসন্ন কোরবানির ঈদে ৩ শতাংশ সুদে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার হিসেবে সহজ শর্তে ক্যাশ ক্রেডিট দেয়ার বিষয়ে ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংককেই যেহেতু সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে জন্য জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে আরও বলা হয়, চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরের কারণে মালিকদের আর্থিক সমস্যা হচ্ছে। এটি নিরসনের জন্য এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স ২২ জুন অনলাইনে সভা করেছে। সেখানে সভাপতিত্ব করেছেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমদু হুমায়ুন।

ওই সভায় আসন্ন কোরবানির ঈদে চামড়া ব্যবসায়ীদের ঋণসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন ও তাদের নতুনভাবে ঋণ সুবিধা, বকেয়া ঋণ বিশেষ বিবেচনায় তফসিলিকরণ, নমনীয় পরিশোধ সূচি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়।

এ জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে শিগগিরই জরুরি সভার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেবে। টাস্কফোর্স সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বৈঠক করে তার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে।

সরকারের কাছে ট্যানারি মালিকদের ১০ প্রস্তাব : করোনাভাইরাসে ট্যানারি শিল্পের আঘাত ও স্থানান্তরজনিত কারণে টিকে থাকার জন্য ১০টি প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। ক্ষতিগ্রস্ত ট্যানারি মালিকরা যাতে চামড়া ব্যবসায় ফিরে আসতে পারেন সেজন্য এসব প্রস্তাব বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়েছে।

প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, ২০১৭-১৯ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করতে হবে। আগের ঋণ ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর, দুই বছরের মরেটরিয়াম সুবিধা দিতে হবে। অনারোপিত, স্থগিত ও দণ্ড সুদ সম্পূর্ণ মওকুফ ও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পরিশোধের নমনীয় সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, আসন্ন কোরবানি ঈদে ৩ শতাংশ সুদে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার ক্যাশ ক্রেডিট হিসেবে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে।

এছাড়া অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে- আগের ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রদান এবং কোরবানির চামড়া কেনার ক্ষেত্রে ঋণ দেয়ার বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ২৯ জুন সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন। সেখানে আরও বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিআরপিডি প্রজ্ঞাপন-১৫ নম্বর অনুযায়ী চামড়া ব্যবসায়ীদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এখানে চামড়া ব্যবসায়ী বলতে কারা সেটি স্পষ্ট নয়। কারণ ট্যানারির মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ী ভিন্ন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে ট্যানারি মালিকদের পূর্বের ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বিষয়ে বিশেষ সুবিধা দেয়ার বিষয়টি প্রতিফলন হয়নি। এর প্রতিফলন দরকার। আর এ প্রজ্ঞাপন ট্যানারি মালিকদের পূর্বের ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবে না।

রফতানির বাজারও মন্দা : রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) এ খাতে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রফতানি আয় কমেছে ২৭ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চামড়া খাতে মোট রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৯ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার, বিপরীতে আয় হয়েছে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

অর্থাৎ আয় কমেছে ২৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে আয় কমেছে ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চামড়াজাত পণ্যে রফতানির প্রবৃদ্ধি কমেছে ১০ দশমিক ৮১ শতাংশ, চামড়ায় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে ফুটওয়্যার রফতানিতে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/324756