৯ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ২:২৯

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার ছোবল, দিশেহারা শিক্ষক-কর্মচারী

অনেকেরই দিন কাটছে অনাহারে অর্ধাহারে

খুলনার আলহাজ সারোয়ার খান কলেজের প্রভাষক নেকবর হোসাইন। মাত্র ৯ হাজার টাকা বেতনে অধ্যাপনা করতেন। দিঘলিয়া উপজেলা শহরে বাসাভাড়া করে থাকতেন তিনি। টিউশনি, কোচিং আর প্রাইভেট পড়িয়ে কোনো রকম সংসার চালাতেন।

করোনার প্রাদুর্ভাবে মধ্য মার্চ থেকে কলেজ বন্ধ থাকায় কোনো বেতন পাচ্ছেন না। বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, সংসার খরচ ইত্যাদি মেটাতে না পারায় বাসা ছেড়ে ফিরে গেছেন নিজ গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ির পাংশায়। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সেখানেই থাকেন। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খাবার এবং ওষুধ খরচ তিনি দিতে পারছেন না।

যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কলেজের আয় বন্ধ। তাই তাদের বেতনও নেই। ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের কারণে এখন টিউশনি-প্রাইভেট বা কোচিংয়েও ছাত্রছাত্রী পড়াতে পারছেন না।

এ অবস্থায় গত রোজার ঈদে তিনি রীতিমতো পরিবার থেকে পালিয়ে ছিলেন। নতুন জামা-কাপড় সংস্থান দূরের কথা, খাবারের ব্যবস্থাও করতে পারছিলেন না। পরে গ্রাম থেকে ‘কিছু’ পাঠানোয় ঈদটা পার করতে পেরেছে তার পরিবার। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের পর তিনি গ্রামে বাড়িতে চলে যান।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল সাকিব। ৫ জনের সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবা ‘স্ট্রোক’ করে বর্তমানে শয্যাশায়ী। প্রতি মাসে তার ওষুধ কিনতে হয় ২ হাজার টাকার। বোন ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী। মার্চে তিনি আংশিক বেতন পেয়েছেন। এরপর এখন পর্যন্ত আর কোনো বেতন-ভাতা পাননি। ধার-দেনা করে সংসারের অতি প্রয়োজনীয় খরচ চালাচ্ছেন।

আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ডিসেম্বরে বিয়ে করেন। তিনিও মার্চ-এপ্রিলে আংশিক বেতন পেয়েছেন। মে মাসের বেতন পাননি। বিবাহিত জীবনের প্রথম ঈদে স্ত্রীকে কিছুই দিতে পারেননি।

এমন পরিস্থিতিতে ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা পাওয়ায় সংসার টেনেটুনে চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। শুধু নেকবর, সাকিব বা মিজান নয়- তাদের মতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ করোনাকালে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। কেউ চলছেন ধার-দেনা করে বা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে সাহয্য নিয়ে। দোকান থেকে বাকি নিয়ে চলছে অনেকের দিন। আবার অনেকে বাধ্য হয়ে এ ছুটিতে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম ও ছোটখাটো ব্যবসায় ভিড়ে গেছেন।

নেকবর হোসাইন বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফোরামের সভাপতিও। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজের আয় খুব কম। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক-কর্মচারীদের নামেমাত্র বেতন-ভাতা দিত। কিন্তু করোনা আসার পর সেই উপার্জনও কলেজের বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন সেই সামান্য বেতন-ভাতাও দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষকরা টিউশনি-কোচিং বা ছোটখাটো ব্যবসা করে চললেও সেই বিকল্প আয়ও কেড়ে নিয়েছে করোনা। তিনি বলেন, সরকার শিক্ষকদের ৫ হাজার আর কর্মচারীদের আড়াই হাজার টাকা করে এককালীন প্রণোদনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা প্রতি মাসে সহায়তা করলেও শিক্ষকদের মুখে হাসি ফুটত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে বেসরকারি, নন-এমপিও এবং প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৬০ হাজার। এগুলোর মধ্যে ৪০ হাজারই কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল। ২ হাজার বিভিন্ন রকম আধা-এমপিও ও বেসরকারি স্কুল। এছাড়া নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা প্রায় সাড়ে ৮ হাজার, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পৌনে ১০ হাজার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৯৬টি।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেজি স্কুলগুলোতে ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। কারিগরি প্রতিষ্ঠানে জনবল আছে প্রায় আড়াই লাখ। বেসরকারি নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আছেন আরও প্রায় ৯০ হাজার। আর ৯৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ২৯ হাজার। এছাড়া শতাধিক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে দেশে, যেখানে আরও কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। অনার্স-মাস্টার্স কলেজে শিক্ষক আছেন সাড়ে ৫ হাজার। এদের বেশির ভাগের বেতন-ভাতা অনিয়মিত হয়ে গেছে।

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বিকে নিু মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছাত্রীদের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তারা টিউশন ফি নিতে পারতেন না। শুধু সরকার থেকে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রীদের বিপরীতে পাওয়া টিউশন ফি’র আয় থেকে তাদের বেতন-ভাতা হতো। এ কারণে খণ্ডকালীন চাকরি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, টিউশনি-কোচিং করে তাদের সংসার চলত। করোনা আবির্ভাবের পর ব্যবসা-টিউশনি সবই বন্ধ। এখন ধার-দেনা করে কোনো রকমে তাদের সংসার চলছে।

কেজি স্কুলগুলোর একটি রাজধানীর জুরাইন আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী শিক্ষক মোশারেফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের সব রকমের আয় বন্ধ। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেয়া দূরের কথা, প্রতিষ্ঠানের বাড়িভাড়াই দিতে পারছেন না পরিচালক। করোনার দুঃসময় কেটে যাওয়ার অপেক্ষা কাটছে না। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেনার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, মার্চে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বেতন দিয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান দিয়েছে আংশিক বেতন। কিছু প্রতিষ্ঠান বেতন-ভাতা দেয়নি। আগে টিউশনি-কোচিং থেকে তাদের কিছু আয় হতো। করোনায় কারও বাসায় যাওয়া যাচ্ছে না। আবার সরকারিভাবে কোচিং সেন্টারও বন্ধ। ফলে আয়শূন্য হয়ে এখন ধার আর পরিচিত দোকান থেকে বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে চলছে তাদের সংসার।

কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সবই ভাড়াবাড়িতে চলে। ওই ভাড়া এবং শিক্ষক বেতনের সংস্থান হয় টিউশন ফি থেকে। মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করতে পারেননি। তাই শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা দেয়া দূরের কথা, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালাতে পারছেন না। এ অবস্থায় অনেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছেন। আবার অনেকে বিক্রির নোটিশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে ৫শ’ কোটি টাকা প্রণোদনা চেয়েছি। তবে কোনো সাড়া মেলেনি।

দেশের বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ। প্রতিষ্ঠানটি আড়াই মাস ধরে বেতন দিচ্ছে না শিক্ষক-কর্মচারীদের।

বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মাকসুদ উদ্দিন বলেন, আমরা এপ্রিলের ১৫ দিনের বেতন দিয়েছি। এরপর পারিনি। তবে পরে যদি সামর্থ্য তৈরি হয় তাহলে বকেয়া দেয়ার চেষ্টা করব। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ ২ মাস ধরে সবেতনে নিযুক্ত শিক্ষকদের বেতন ছাড় করছে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

জানা গেছে, ক্যামব্রিয়ান ও ট্রাস্টসহ এ ধরনের বেশিরভাগ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা নিয়মিত পাচ্ছেন না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতেও একই অবস্থা চলছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর উত্তরার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, প্রতিষ্ঠান ঠিকই টিউশন ফি নিচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনো বেতন-ভাতা দিচ্ছে না।

সরকারি অনুদান : বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেছে সরকার। ২৪ জুন স্কুল ও কলেজের প্রায় ৮১ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা অনুদানের অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে শিক্ষকরা এককালীন পাঁচ হাজার ও কর্মচারীরা দুই হাজার পাঁচশ’ করে টাকা পাবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে এ টাকা বিতরণ শুরু হবে। কারিগরি ও মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদেরও সহায়তা করা হবে বলে জানা গেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/324085